লালন শাহ্ ফকিরের গান কবিতার প্রশ্নোত্তর দ্বিতীয় সেমিস্টার একাদশ শ্রেণি বাংলা | Lalon Shah Fokirer Gaan Kobitar Question Answer 2nd Semester Class 11 Bengali wbchse
📌 একাদশ শ্রেণি প্রশ্নপত্র সেমি-২ Click Here
📌 একাদশ শ্রেণি প্রশ্নোত্তর বাংলা Click Here
📌 একাদশ শ্রেণি সিলেবাস বাংলা Click Here
রচনাধর্মী প্রশ্নোত্তর : লালন শাহ্ ফকিরের গান কবিতা একাদশ শ্রেণি বাংলা দ্বিতীয় সেমিস্টার | Lalon Shah Fokirer Gaan Kobitar Essay Type Question Answer 2nd Semester Class 11 Bengali wbchse
∆ অনধিক ১৫০ শব্দের মধ্যে উত্তর দাও : প্রতিটি প্রশ্নের মান- ৫
প্রশ্ন ১। লালন শাহ্ কে ছিলেন ? পাঠ্য লালন গীতিকা অবলম্বনে মূল বিষয়টি ব্যাখ্যা করো। ২+৩
উত্তরঃ লালন ছিলেন বহুমুখী প্রতিভার অধিকারী একজন আধ্যাত্মিক সাধক; যিনি ফকির লালন, লালন সাঁই, লালন শাহ, মহাত্মা লালন ইত্যাদি নামেও পরিচিত। তিনি একাধারে একজন আধ্যাত্মিক ফকির সাধক, মানবতাবাদী, সমাজ সংস্কারক এবং দার্শনিক। তিনি অসংখ্য গানের গীতিকার, সুরকার ও গায়ক ছিলেন। তিনি বাংলাদেশে বাউল গানের শ্রেষ্ঠতম রচয়িতা।
মূল বিষয়টির ব্যাখ্যা : খাঁটি বা শুদ্ধ মানুষ হতে গেলে মানুষকেই ভজনা করতে হবে। মানুষের থেকে বিচ্ছিন্ন হলে ‘মনের মানুষ’-এর সন্ধান পাওয়া যাবে না। দ্বি-দল প্রস্ফুটিত হয় আজ্ঞাচক্রে। আর সেই দ্বি-দলের পদ্মে ‘সোনার মানুষ’ উজ্জ্বল হয়ে ওঠে। কেবল গুরুর কৃপা হলেই এই সত্য জানা সম্ভব। মানুষের মধ্যেই মানুষের গাথা বা কাহিনি রচিত হয়ে আছে আলেক লতার মতো। অর্থাৎ পার্থিব মানবশরীরের মধ্যেই বিরাজ করেন ‘সহজ মানুষ’, ঠিক যেমন লতা গাছের অলক্ষে বা দৃশ্যমানতার আড়ালে থাকে। এই সব কিছু জেনেও যে মুণ্ডিতমস্তক হয়, সে আসলে ‘জাত’-কে অবলম্বন করে মুক্তি খোঁজে। কিন্তু মানুষের সঙ্গসুখ ছাড়া মানুষের মন অর্থহীন এবং মহাশূন্য। তাই লালন বলেন যে, মানুষকে ভজনা করলেই একমাত্র ত্রাণ পাওয়া যাবে।
প্রশ্ন ২। লালন শাহ্ ফকিরের গান’-এর মূল ভাবনা কী ? বাউল সাধনার বিভিন্ন দিক যেভাবে প্রকাশিত হয়েছে তা আলোচনা করো। ২+৩
উত্তরঃ ‘লালন শাহ্ ফকিরের গান’-এর ভণিতায় লালন বলেছেন যে, মানুষ-আকার ভজনা করলেই একমাত্র ত্রাণ পাওয়া যায়।
লালন তাঁর বিভিন্ন গানে বারে বারে মানবতার কথা উচ্চারণ করেছেন। এই গানেও লালন বলেছেন মানুষকে ভজনার কথা। শুধু তাই নয়, মানুষের মধ্যেই যে শুদ্ধতম মানুষ বা মনের মানুষ রয়েছে তার সন্ধান করার কথাও কবি বলেছেন। মানুষ ছাড়া মন নিরর্থক। সেকারণে লালন বলেছেন যে, প্রকৃত মুক্তি পেতে গেলে মানুষ- ভজনা করতেই হবে।
‘লালন শাহ্ ফকিরের গান’ লালন ফকিরের অন্যতম প্রতিনিধিস্থানীয় গান। স্বাভাবিকভাবেই বাউল সাধনার অনেকগুলি গুরুত্বপূর্ণ দিক এবং অনুষঙ্গ এই গানে পাওয়া যায়।
প্রথমত, বাউল সাধকরা সর্বমানবতার ওপরে গুরুত্ব দেয়। এখানেও লালন ফকির বলেছেন, “মানুষ ভজলে সোনার মানুষ হবি”।
দ্বিতীয়ত, বাউল দর্শনে আত্মতত্ত্ব একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ জুড়ে থাকে। এই কবিতাতেও মনের ভিতরে ‘মনের মানুষ’-এর সন্ধান একটা গুরুত্বপূর্ণ অংশ হয়ে আছে,-“এই মানুষে মানুষ গাথা/দেখনা যেমন আলেক লতা”।
তৃতীয়ত, বাউল সাধনার অনেক পরিভাষা ও অনুষঙ্গ এই কবিতাতে পাওয়া যায়। যেমন-‘দ্বি-দলের মৃণাল’, ‘আলেক লতা’ ইত্যাদি। এইভাবে সাধনতত্ত্বের নিরিখে এবং জীবনবোধে ‘লালন শাহ্ ফকিরের গান’ বাউল সাধনার এক উজ্জ্বল উদ্ধার।
প্রশ্ন ৩। লালন শাহ্ ফকিরের গান’ কবিতায় বাউল সাধনার দেহতত্ব কীভাবে ব্যাখিত হয়েছে, আলোচনা করো।
উত্তরঃ বাউল সাধনা দেহতত্ব : বাউল সাধনা মূলত দেহতত্বের সাধনা। বাউলদের মতে, ঈশ্বরের অস্তিত্ব দেহের মধ্যে বিরাজমান এবং ঈশ্বরকে উপলব্ধি করতে হলে দেহের মাধ্যমে সাধনা করতে হয়। বাউল সাধনা একে অপরকে পরিপূর্ণ করতে চায়, এবং এই সাধনার মূল উদ্দেশ্য হচ্ছে দেহের মাধ্যমে আত্মার মুক্তি অর্জন। বাউল সাধনায় সাধক বা সাধিকাকে শরীরের ভেতরের শক্তি বা “শুক্র” (যাকে বাউলরা “দেহের শুক্র” বা জীবনশক্তি বলেন) থেকে শক্তি সঞ্চয় করতে হয়।
বাউল ধর্মে বলা হয় যে, দেহই সাধনার মূল উপকরণ এবং ঐ দেহের মধ্যে ঈশ্বর বিরাজিত। “দেহতত্ব” এর মাধ্যমে তারা এই দেহকে ঈশ্বরের উপাসনার মাধ্যম হিসেবে ব্যবহার করতে শেখে। এই দেহই তাদের সাধনার মাধ্যমে পরম সুখ বা পরম আনন্দের স্তরে পৌঁছায়। এভাবেই তারা অলক্ষ বা অলৌকিক ঈশ্বরের উপস্থিতি অনুভব করে। ‘লালন শাহ্ ফকিরের গান’ কবিতায় লালন শাহ্ এই দেহতত্বের গুরুত্ব তুলে ধরেছেন, যেখানে দেহ এবং মন এক হয়ে ঈশ্বরের সাধনা করতে হবে।
সাধকের সাধনা এবং সংযমের মাধ্যমে সুষুম্না নাড়ি (যেখানে জীবনের শক্তি প্রবাহিত হয়) খোলার চেষ্টা করা হয়, এবং এই খোলার মধ্য দিয়ে তারা অলক্ষ ঈশ্বরের অস্তিত্ব অনুভব করেন। তারা বিশ্বাস করেন, দেহের মাধ্যমেই ঈশ্বরের মিলন সম্ভব এবং এর মাধ্যমে একটি গভীর আনন্দ বা পরম সুখ লাভ করা যায়।
প্রশ্ন ৪। “মানুষ-গুরু কৃপা হ’লে / জানতে পাবি।।” – ‘মানুষ-গুরু’ কে ? তাঁর কৃপা কীভাবে জানা যায় ?
উত্তরঃ ‘মানুষ-গুরু’ : কবি-সাধক লালন শাহ্ রচিত ‘লালন শাহ্ ফকিরের গান’ কবিতায় ‘মানুষ-গুরু’ বলতে এমন একজন পরম সাধক বা গুরুকে বোঝানো হয়েছে, যিনি দেহের বাইরে থাকা পরম ঈশ্বরের প্রতিনিধি। এই গুরু সাধকই প্রকৃত ঈশ্বরের পরিচায়ক। সাধকের মধ্যে ঈশ্বরের উপস্থিতি থাকে, তবে তাঁকে চোখে দেখা যায় না। ‘মানুষ-গুরু’ হল সেই সাধক, যিনি ঈশ্বরের রূপে পূর্ণ, এবং তাঁর কৃপা লাভের মাধ্যমে সাধক আধ্যাত্মিক জ্ঞান অর্জন করেন।
কৃপা জানার উপায় : তাঁর কৃপা জানার জন্য, সাধককে তাঁর সাধনার মধ্যে গভীর প্রতিশ্রুতি ও নিষ্ঠা অনুসরণ করতে হয়। সাধক যতক্ষণ না তার সাধনায় সিদ্ধি অর্জন করেন, ততক্ষণ তিনি মন থেকে অতৃপ্তি এবং অন্ধকারে আবৃত থাকেন। তবে যখন সেই ‘মানুষ-গুরু’ তার সাধনায় সিদ্ধ হয়ে পূর্ণ পরিতৃপ্তি লাভ করেন, তখন তিনি কৃপা প্রদর্শন করেন। সাধক দেহতত্ত্ব অনুসরণ করে এবং নিজেকে পরিশুদ্ধ করে সেই কৃপা অনুভব করেন। এই কৃপা লাভের পর, সাধক ঈশ্বরের সঙ্গে একাত্ম হতে পারেন, এবং তখন তিনি ‘মানুষ-গুরু’-এর কৃপা ও প্রজ্ঞা উপলব্ধি করতে সক্ষম হন।
প্রশ্ন ৫। ‘লালন শাহ কে ছিলেন ? পাঠ্য লালন গীতিকা অবলম্বনে মূল বিষয়টি ব্যাখ্যা করো।
উত্তরঃ লালন ফকির ছিলেন বাউল সাধনার প্রধান গুরু। তিনি অসংখ্য বাউল গান। রচনা করেছেন। ১১৭৯ বঙ্গাব্দের ১ কার্তিক (১৭৭২) তাঁর জন্ম। তবে তাঁর জন্মসাল, জন্মভিটা, জাতিসূত্র এবং গানের সংখ্যা নিয়ে বহু বিতর্ক রয়েছে।
লালনকে নিয়ে মানুষের আগ্রহের শেষ নেই। তাঁকে ঘিরে বহু জনশ্রুতি, অসংখ্য সত্য-মিথ্যা গল্প প্রচলিত। শোনা যায়, তীর্থভ্রমণের পথে দুরারোগ্য বসন্তে আক্রান্ত হয়ে তিনি সঙ্গীদের দ্বারা পরিত্যক্ত হন। তখন সিরাজ সাঁই তাঁকে নিজের গৃহে এনে সেবা-শুশ্রুষা করে সুস্থ করে তোলেন।
ব্যাখ্যা : লালনের গানে মানব মহিমা অনবদ্য ভাষায় প্রকাশিত হয়েছে। তিনি লিখেছেন: “এই আছে রে মন, যারে বলে মানুষ রতন লালন বলে, পেয়ে সে ধন পারলাম না রে চিনিতে।।”
লালন সহজ সাধনার পথ বেছে নিয়েছিলেন। তিনি কোনো ধরনের সামাজিক বা ধর্মীয় সংস্কারকে গুরুত্ব দেননি। তাঁর মতে, মানুষ ছাড়া মানুষের মুক্তি নেই। তিনি মানুষের মধ্যেই অরূপ রতন সন্ধান করেছেন। লালন মরমি ধারার সাধক ছিলেন, যিনি মনের মনের সঙ্গে মিলিত হওয়ার আকাঙ্ক্ষা প্রকাশ করেছেন।
লালনের দর্শনে বলা হয়েছে, ঈশ্বর বা আল্লাহ যদি থাকেন, তবে তিনি মানুষের মধ্য দিয়েই প্রকাশিত হন। তিনি বলেছেন- “মানুষ ভজলে সোনার মানুষ হবি নইলে পরে ক্ষ্যাপারে তুই মূল হারাবি।”
লালনের গানে তত্ত্বের কথা ধরা দিয়েছে। তাঁর দর্শনে ‘সোনার মানুষ’-এর সন্ধান পাওয়া যায়। তিনি ‘মানুষ-গুরু’কে স্বীকার করেছেন এবং অনুভব করেছেন যে, ‘মানুষ-গুরু’র কূপা ছাড়া ঈশ্বরের মাহাত্ম্য উপলব্ধি করা যায় না। তাই লালন গেয়েছেন:
“মানুষ ছাড়া মন আমার পড়বি রে তুই শূন্যকার।”
‘লালন শাহ ফকিরের গান’ মূলত মানব বন্দনার গান। এখানে লালনের সহজ সাধনা এবং মানবতত্ত্বই প্রকাশ পেয়েছে।
প্রশ্ন ৬। লালন শাহ ফকিরের গানে কীভাবে মানব বন্দনা হয়েছে তা লেখো।
উত্তরঃ লালন শাহ্ জাতিভেদ, ধর্মীয় সংস্কার, আচার-বিচার, এবং কুসংস্কারে বিশ্বাস রাখতেন না। তিনি সংস্কারমুক্ত এবং সাম্প্রদায়িক ভেদবুদ্ধি থেকে মুক্ত এক মানবতাবাদী সাধক ছিলেন। তাঁর কাছে মানুষই ছিল পরম সত্য। লালন বলেছেন—
“সব লোকে কয় লালন কি জাত সংসারে।”
উপেন্দ্রনাথ ভট্টাচার্যের মতে, মানুষের দেহ ও মন বাউল সাধনার কেন্দ্রবিন্দু। বাউলদের কাছে মানুষই পরম সম্পদ। তাঁরা মানুষকে ‘মানুষ রতন’ নামে চিহ্নিত করেন এবং বিশ্বাস করেন মানুষের মধ্যেই ‘মনের মানুষ’ তথা ঈশ্বর অবস্থান করেন। বাইরের কোনো উপচার বা আরাধনার মাধ্যমে তাঁকে পাওয়া সম্ভব নয়।
লালন তাঁর গানে বলেছেন—
“মানুষের মধ্যে রয়েছে সেই পরম সত্তা।”
এই সত্য বোঝাতে তিনি আরও বলেছেন—
“মানুষে মানুষ আছে, যাবে জানা।”
লালনের মতে, পরম মানুষকে অনুভব করতে হলে প্রথমে নিজের মধ্যে ঈশ্বরের অস্তিত্ব উপলব্ধি করতে হয়। বাইরের কোনো আরাধনায় তাঁকে পাওয়া যায় না। মানুষরূপী গুরুর কৃপা ছাড়া পরম সত্তার উপলব্ধি অসম্ভব।
“মানুষ ছাড়া মন আমার পড়বি রে তুই শূন্যকার।”
লালনের গানে মানুষের জয়ধ্বনি করা হয়েছে। তিনি বিশ্বাস করতেন, মানুষের মধ্যেই ঈশ্বর বাস করেন এবং মানুষকে বাদ দিয়ে ঈশ্বরের সন্ধান করা অর্থহীন। বাউল ধর্ম কোনো আরোপিত ধর্ম নয়; এটি সহজ সাধনার পথ। লালন বলেছেন: “আপন ভজন-কথা না কহিবে যথা-তথা।”
পরম সত্তাকে অনুভব করতে হলে গোপনীয়তা রক্ষা এবং সহজ সাধনার প্রয়োজন। লালনের গানে এই সহজ সাধনার পথ অন্বেষণ করা হয়েছে। মানবতাবাদই তাঁর দর্শনের মূল কথা। সুতরাং, লালন শাহ ফকিরের গান আসলে মানব বন্দনার সুরেই রচিত।
প্রশ্ন ৭। “মানুষ ভজলে সোনার মানুষ হবি।”- মানুষকে ভজনা করলে কীভাবে ‘সোনার মানুষ’ হওয়া যায় ?
উত্তরঃ বাউল সাধক লালন প্রথাগত ধর্ম বা আচার-বিচারে বিশ্বাসী ছিলেন না। তিনি লোকায়ত সাধনার মাধ্যমে মানুষের অন্তরে ঈশ্বরের সন্ধান করেছেন। তাঁর মতে, ঈশ্বরকে পেতে হলে মনের মানুষকে খুঁজতে হবে এবং মানুষের প্রতি ভক্তি ও শ্রদ্ধা প্রদর্শন করতে হবে।
লালন বলেছেন—
“মনের মানুষ মনের মাঝে করো অন্বেষণ।”
মানুষকে ভালোবাসা এবং শ্রদ্ধা করা ছাড়া ঈশ্বরকে পাওয়া সম্ভব নয়। লালন বিশ্বাস করতেন, মন্দির-মসজিদে পরম শক্তিকে পাওয়া যায় না। বরং মানুষের মধ্যেই ঈশ্বরের বসবাস। তাই মানুষকে ভজনা করার মাধ্যমেই ‘সোনার মানুষ’ বা পরম সত্তাকে উপলব্ধি করা সম্ভব।
তিনি আরও বলেন, মানুষরূপী গুরুর কৃপা ছাড়া ঈশ্বরের সান্নিধ্য পাওয়া যায় না। এই ‘গুরু’ হলেন মানুষের মধ্যেই বিদ্যমান এক বিশেষ সত্তা, যাঁর কৃপায় মানুষ সত্যিকারের জ্ঞানে উন্নীত হয়। লালনের মতে, মানুষকেই ভক্তি করলে, তাঁর মধ্যেই ঈশ্বরের প্রতিচ্ছবি দেখা সম্ভব।
বাউল সাধনা আসলে মানবপ্রেমের সাধনা। এই সাধনা তন্ত্র বা বেদনির্ভর নয়, বরং সহজ ও মানবিক। লালন বিশ্বাস করতেন, মানুষই ঈশ্বরের প্রকৃত রূপ, তাই মানুষকে বাদ দিয়ে কোনো সাধনা বা ঈশ্বরের সন্ধান বাস্তবায়িত হতে পারে না।
সুতরাং, মানুষকে ভালোবাসার মধ্য দিয়েই একজন সাধক ‘সোনার মানুষ’ বা পরম মানবীয় সত্তার পূর্ণতা অর্জন করতে পারে।
প্রশ্ন ৮। মানুষ ছেড়ে ক্ষ্যাপারে তুই মূল হারাবি।”– ‘ক্ষ্যাপার’ প্রতি এই সাবধানবাণী কেন ?
উত্তরঃ লালন শাহ্ তাঁর সাধনায় মানবপ্রেমকে সর্বোচ্চ স্থান দিয়েছেন। তাঁর মতে, মানুষকে বাদ দিয়ে ধর্মচর্চা বা সাধনা কোনো অর্থ বহন করে না। এই বক্তব্যে ‘ক্ষ্যাপা’ বলতে বোঝানো হয়েছে সেই ব্যক্তি বা সাধককে, যিনি মানুষকে বাদ দিয়ে ঈশ্বর বা পরম শক্তির সন্ধান করতে চান। লালন এ ধরনের আচরণের বিপদ সম্পর্কে সাবধান করে দিয়েছেন।
লালন বিশ্বাস করতেন, মানুষই ঈশ্বরের প্রকৃত আধার। তিনি বাইরের মন্দির, মসজিদ, বা পুথিপাঠের মধ্যে ঈশ্বরের সন্ধান করার চেয়ে মানবমনের গভীরে ঈশ্বরের অস্তিত্ব খুঁজতে বলেছেন। তাঁর মতে, মানুষ ছাড়া ধর্ম, সাধনা বা ঈশ্বরচিন্তা অসম্পূর্ণ। এই কারণেই তিনি বলেছেন: “মানুষ ভজলে সোনার মানুষ হবি।”
লালন অলৌকিকতা, ভণ্ডামি, এবং জাতিভেদের বিপক্ষে ছিলেন। তাঁর মতে, যদি মানুষকে উপেক্ষা করা হয়, তবে ঈশ্বরের সন্ধান মিথ্যা হয়ে যায়। তিনি মনে করতেন, মানুষ-গুরু বা ‘মনের মানুষ’-এর প্রতি শ্রদ্ধা না থাকলে সমস্ত সাধনা শূন্য হয়ে পড়ে। তাই ‘ক্ষ্যাপা’ যদি মানুষকে ছেড়ে অন্য কোথাও পরম সত্তার খোঁজ করেন, তবে তাঁর মূল লক্ষ্য হারিয়ে যাবে।
লালনের এই চিন্তাধারা চৈতন্যদেবের মানবপ্রেমের ভাবনার সঙ্গে মিলিত। মধ্যযুগে চৈতন্যদেব ঘোষণা করেছিলেন, মানুষের মধ্যে ঈশ্বর বিরাজমান। একইভাবে, লালনও বলেছেন, মানুষের মধ্যেই ‘সোনার মানুষ’ বা ‘পরম মানুষ’-এর অস্তিত্ব রয়েছে।
সুতরাং, লালনের এই সাবধানবাণী ‘ক্ষ্যাপা’কে সঠিক পথে রাখার একটি দিকনির্দেশনা, যাতে সে তার সাধনার মূল লক্ষ্য হারিয়ে না ফেলে।
প্রশ্ন ৯। “মানুষ ভজলে সোনার মানুষ হবি” এবং “দ্বি-দলের মৃণালে সোনার মানুষ উজ্জ্বলে” এই দুই পঙক্তিতে ‘সোনার মানুষ’ শব্দটি কোন কোন অর্থে ব্যবহৃত হয়েছে ?
উত্তরঃ প্রথম অর্থ : লালন শাহ্ রচিত “মানুষ ভজলে সোনার মানুষ হবি” পঙক্তিতে ‘সোনার মানুষ’ শব্দটি ব্যবহৃত হয়েছে মনুষ্যত্বে উন্নীত এক খাঁটি মানুষের অর্থে। লালন এখানে বোঝাতে চেয়েছেন, মানুষের মধ্যে যে মানবধর্ম এবং মানবতার সত্য বিদ্যমান, সেটি অন্বেষণের মাধ্যমে সাধারণ মানুষ একদিন খাঁটি মানুষ বা ‘সোনার মানুষ’-এ পরিণত হতে পারে।
মানুষের মধ্যে ঈশ্বরের বাস-এই ধারণার উপর ভিত্তি করে বাউল দর্শনে বলা হয়েছে, মানুষের সঙ্গে মানুষের সেবা ও ভালোবাসার সম্পর্কই ঈশ্বরের নিকট পৌঁছানোর একমাত্র পথ। কঠোর সাধনা, আত্মোপলব্ধি ও মানবপ্রেমের মাধ্যমে একজন সাধারণ ব্যক্তি নিজেকে ‘সোনার মানুষ’-এ উন্নীত করতে পারে, যেমন পরশমণির স্পর্শে লোহা সোনায় পরিণত হয়। এই খাঁটি মানুষই মানবতার সর্বোচ্চ স্তরে পৌঁছে ‘মানুষ রতন’ হয়ে ওঠে।
দ্বিতীয় অর্থ : “দ্বি-দলের মৃণালে সোনার মানুষ উজ্জ্বলে”
পঙক্তিতে ‘সোনার মানুষ’ শব্দটি ব্যবহৃত হয়েছে ৭মনের মানুষ, অন্তরাত্মা বা পরমপুরুষ অর্থে। এখানে ‘সোনার মানুষ’ হলেন সেই চিরন্তন সত্তা, যিনি মানবদেহের অন্তরে অবস্থান করেন।
বাউল দর্শনে ঈশ্বর বা ‘পরমপুরুষ’কে বাইরের মন্দির, মসজিদ, বা কোনো বাহ্যিক উপাসনালয়ে খুঁজে পাওয়া যায় না। তিনি মানুষের শরীরের ছয় চক্রের আজ্ঞা চক্রে অবস্থান করেন। সাধনা ও আত্মোপলব্ধির মাধ্যমে তাঁকে উপলব্ধি করা সম্ভব। এখানে ‘সোনার মানুষ’ ঈশ্বরতুল্য এক পরমাত্মার প্রতীক, যিনি জীবাত্মার মাধ্যমে প্রকাশিত হন।
প্রশ্ন ১০। “দেখ না যেমন আলেক লতা”– ‘আলেক লতা’ শব্দটির অর্থ এবং কবি তাঁর সান্নিধ্য কেন চেয়েছেন ?
উত্তরঃ আলেক লতার অর্থ : ‘আলেক লতা’ শব্দটি একটি বিশেষ আধ্যাত্মিক প্রতীক হিসেবে ব্যবহৃত হয়েছে। আলেক লতা বাস্তবে একটি পরজীবী উদ্ভিদ, যা অন্য গাছের গায়ে জড়িয়ে থাকে এবং তার থেকে খাদ্য গ্রহণ করে বাঁচে। তবে লালন শাহ্ এখানে এই শব্দটির গভীর আধ্যাত্মিক অর্থ দিয়েছেন। ‘আলেক’ শব্দটি অলক্ষ্য বা অদৃশ্য পরমাত্মাকে নির্দেশ করে, যে পরমাত্মা মানবদেহের মধ্যে বিরাজমান। ‘লতা’ এখানে পরমাত্মার সঙ্গে মানুষের আত্মার সম্পর্ককে বোঝায়, যেমন এক পরজীবী উদ্ভিদ তার জীবনের জন্য অন্য গাছের ওপর নির্ভরশীল থাকে, তেমনি পরমাত্মাও মানুষের আত্মায় বিরাজমান। বাউল ধর্মে পরমাত্মাকে ‘আলেক সাঁই’ বা ‘অলখ-নিরঞ্জন’ বলা হয়, যা মানে ঈশ্বর বা সৃষ্টির উৎস, যে কোন ভৌত রূপ ধারণ করে না।
কবি কেন সান্নিধ্য চেয়েছেন : লালন শাহ্ তাঁর গানে পরমাত্মার সান্নিধ্য লাভের জন্য ব্যাকুল হয়ে উঠেছেন। তিনি বিশ্বাস করতেন যে, পরমাত্মার অস্তিত্ব মানবদেহের মধ্যে বিরাজমান, এবং তাকে উপলব্ধি করতে হলে, সাধনা ও গভীর অন্তর্দৃষ্টির প্রয়োজন। আলেক লতা বা অলখ-নিরঞ্জন, যেমন একটি উদ্ভিদ অন্য গাছের মধ্যে আটকে থাকে, তেমনি পরমাত্মাও মানুষের অন্তরে মিশে থাকে। তাই, লালন সাঁই পরমাত্মার সান্নিধ্য চেয়েছেন, যাতে তাঁর জীবনের পূর্ণতা আসে। তিনি বিশ্বাস করতেন, যদি একজন ব্যক্তি পরমাত্মার সান্নিধ্য লাভ করতে পারে, তবে সে মানবধর্মের পূর্ণতা লাভ করবে এবং পরমাত্মার মিলনে মুক্তি পাবে। তাই তাঁর জন্য আলেক লতার সান্নিধ্য ছিল পরমাত্মার সাথে একত্ববোধ ও আত্মার মুক্তির পথ।
প্রশ্ন ১১। “লালন শাহ ফকিরের গান” গীতি কবিতাটির মধ্যে রচয়িতার যে মনোভাব ফুটে উঠেছে, তা নিজের ভাষায় লেখো।
উত্তরঃ মানবতত্ত্বের স্বরূপ : লালন শাহের রচনায় মানবতত্ত্বের গভীর ব্যাখ্যা পাওয়া যায়। তিনি বিশ্বাস করতেন, মানবদেহই ঈশ্বরসাধনার কেন্দ্র। দেহতত্ত্বের মাধ্যমে পরমাত্মার সন্ধান করা যায়। তাঁর মতে, জাগতিক কামনা-বাসনা ত্যাগ করে সহজিয়া বাউল সাধনার পথ ধরে মুক্তি লাভ করা সম্ভব। কিন্তু এই মুক্তি অর্জনের জন্য মানুষকেই অনুসন্ধান করতে হবে, কারণ মানবদেহের বাইরে ঈশ্বরের অস্তিত্ব অন্বেষণ করা অর্থহীন।
মানবসত্তার স্বরূপ : লালন শাহ মানবসত্তার বিশ্লেষণে বলেছেন, ক্ষিতি, অপ, তেজ, মরুৎ, ব্যোম-এই পঞ্চভূত যেমন জগৎ সৃষ্টির উপাদান, তেমনই মানবদেহেও এই উপাদান বিদ্যমান। ঈশ্বর, যিনি সর্বত্র বিরাজমান, তিনিও এই পঞ্চভূতের মাধ্যমে মানবদেহে বাস করেন। লালন সাঁই এই ধারণাকে তাঁর গানে ফুটিয়ে তুলেছেন, যেখানে তিনি বলেছেন-“এই মানুষে মানুষ গাথা।” অর্থাৎ মানুষ ও মানুষের অন্তরাত্মার মধ্যে গভীর সংযোগ রয়েছে, যা ঈশ্বরসাধনার পথ দেখায়।
মানবতার সুর : “লালন শাহ ফকিরের গান”-এর মূল সুর মানবতাবাদ। লালন জাতি, ধর্ম, বর্ণের ভেদাভেদের ঊর্ধ্বে উঠে মানুষকেই সর্বোচ্চ স্থান দিয়েছেন। তাঁর মতে, মানুষকে সত্যিকারের মানুষ হতে হলে মনুষ্যত্বের সাধনা করতে হবে। মানুষ-গুরুর কৃপায় অন্তরের অজ্ঞতার অন্ধকার দূর হয়ে জ্ঞানের আলো ফুটে ওঠে। এই জ্ঞানই মানুষকে খাঁটি মানুষ, সোনার মানুষে রূপান্তরিত করে।
লালনের মনোভাব : লালনের গান থেকে স্পষ্ট হয়, তিনি বিশ্বাস করতেন “সবার উপরে মানুষ সত্য, তাহার উপরে নাই।” তাঁর আধ্যাত্মিক চিন্তাধারায় তিনি মানবতাকেই ঈশ্বরপ্রাপ্তির পথে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিয়েছেন। তাঁর রচনায় যে মানবতাবাদী সুর ধ্বনিত হয়েছে, তা শুধুমাত্র ধর্মীয় নয়, সামাজিক ও সাংস্কৃতিকভাবেও গভীর তাৎপর্যপূর্ণ। লালন এই বার্তাই দিতে চেয়েছেন যে, মানুষে মানুষে ভেদাভেদ ভুলে মানবতাকে সর্বোচ্চ স্থান দিতে হবে।
◆ দ্বিতীয় সেমিস্টার বাংলা প্রশ্নোত্তর
◆ তেলেনাপোতা আবিষ্কার পাঠ্য বইয়ের গল্প
◆ তেলেনাপোতা আবিষ্কার গল্পের বিষয়বস্তু
◆ তেলেনাপোতা আবিষ্কার গল্পের প্রশ্নোত্তর
◆ ভাব সম্মিলন কবিতার বিষয়বস্তু
◆ ভাব সম্মিলন কবিতার প্রশ্ন উত্তর
◆ লালন শাহ্ ফকিরের গান বিষয়বস্তু
◆ লালন শাহ্ ফকিরের গান প্রশ্নোত্তর
◆ বই কেনা প্রবন্ধের প্রশ্ন উত্তর
◆ আজব শহর কলকেতা প্রবন্ধের প্রশ্নোত্তর
◆ পঁচিশে বৈশাখ প্রবন্ধের প্রশ্ন উত্তর
◆ আড্ডা প্রবন্ধের প্রশ্ন ও উত্তর
◆ আধুনিক বাংলা সাহিত্যের ধারা (৩য়) প্রশ্নোত্তর
◆ লৌকিক সাহিত্যের নানা দিক (৪র্থ) প্রশ্নোত্তর
📌 আরো দেখুনঃ
📌 একাদশ শ্রেণি প্রশ্নপত্র সেমি-২ Click Here
📌 একাদশ শ্রেণি প্রশ্নোত্তর বাংলা Click Here
📌 একাদশ শ্রেণি সিলেবাস বাংলা Click Here
