ভাব সম্মিলন কবিতার বিষয়বস্তু দ্বিতীয় সেমিস্টার একাদশ শ্রেণি বাংলা | Bhab Sommilon Kobitar Bisoibostu 2nd Semester Class 11 Bengali wbbse

ভাব সম্মিলন কবিতার বিষয়বস্তু দ্বিতীয় সেমিস্টার একাদশ শ্রেণি বাংলা | Bhab Sommilon Kobitar Bisoibostu 2nd Semester Class 11 Bengali wbbse

📌 একাদশ শ্রেণি প্রশ্নপত্র সেমি-২ Click Here

📌 একাদশ শ্রেণি প্রশ্নোত্তর বাংলা Click Here

📌 একাদশ শ্রেণি সিলেবাস বাংলা Click Here

সেমিস্টার – II

ভাব সম্মিলন
—বিদ্যাপতি

কি কহব রে সখি আনন্দ ওর।

চিরদিনে মাধব মন্দিরে মোর।।

পাপ সুধাকর যত দুখ দেল।

পিয়া-মুখ-দরশনে তত সুখ ভেল।।

আঁচর ভরিয়া যদি মহানিধি পাই।

তব হাম পিয়া দূর দেশে না পাঠাই।।

শীতের ওঢ়নী পিয়া গীরিষির বা।

বরিষার ছত্র পিয়া দরিয়ার না।।

ভণয়ে বিদ্যাপতি শুন বরনারি।

সুজনক দুখ দিবস দুই-চারি।।

কবি পরিচিতিঃ পঞ্চদশ শতকের মৈথিলি কবি। বঙ্গদেশে তার প্রচলিত পদাবলীর ভাষা ব্রজবুলি। কথিত আছে যে পরমপুরুষ শ্রীচৈতন্য মহাপ্রভু প্রতিদিন তার রচিত পদ গাইতে ভালবাসতেন। বাঙালিরা চর্যাগীতির ভাষা থেকে এই ব্রজবুলীকে অনেক সহজে বুঝতে পারেন। বিদ্যাপতিকে বাঙালি কবিদের অন্যতম হিসেবে গণ্য করা হয়। কবি বিদ্যাপতির জন্ম দ্বারভাঙা জেলার মধুবনী পরগনার বিসফী গ্রামের এক বিদগ্ধ ব্রাহ্মণ পরিবারে। তার রচনাবলির মধ্যে রয়েছে কীর্তিলতা, ভূপরিক্রমা, কীর্তিপতাকা, পুরুষ পরীক্ষা, শৈবসর্বস্বসার, গঙ্গাবাক্যাবলি, বিভাগসার, দানবাক্যাবলি, লিখনাবলি, দুর্গাভক্তি- তরঙ্গিনী। তিনি প্রায় আট শ’ পদ রচনা করেন। বিদ্যাপতি যে বিপুল সংখ্যক পদে রাধাকৃষ্ণের প্রেমলীলা রূপায়িত করেছেন, তার মধ্যে রাধার বয়ঃসন্ধি অভিসার, প্রেমবৈচিত্র্য ও আপেক্ষপানুরাগ, বিরহ ও ভাবসম্মিলনের পদগুলি বিশেষ উৎকর্ষপূর্ণ। কবি বিদ্যাপতি ‘মৈথিল কোকিল’ ও ‘অভিনব জয়দেব’ নামে খ্যাত। এই বিস্ময়কর প্রতিভাশালী কবি একাধারে কবি, শিক্ষক, কাহিনিকার, ঐতিহাসিক, ভুবৃত্তান্ত লেখক ও নিবন্ধকার হিসেবে ধর্মকর্মের ব্যবস্থাদাতা ও আইনের প্রামাণ্য গ্রন্থের লেখক ছিলেন।

ভাবসম্মিলন বা ভাবোল্লাস পর্যায়ের শ্রেষ্ঠ কবি হলেন বিদ্যাপতি।

∆ কবিতার শব্দার্থ—

• কহব = বলব
• সখি = সখী শব্দের সম্বোধন; বন্ধু, সহচরী
• ওর = সীমা-পরিসীমা (ব্রজবুলি শব্দ)
• চিরদিন = চিরকাল
• মাধব = শ্রীকৃষ্ণ
• মন্দির = কবিতায় ‘গৃহ’ অর্থে
• মোর = আমার
• সুধাকর = চাঁদের আলো, জ্যোৎস্না (সুধা কথার অর্থ চাঁদ)
• দুখ = দুঃখ
• দেল = দিল (ব্রজবুলি শব্দ)
• পিয়া = প্রিয় (এখানে কৃষ্ণ)
• দরশন = দর্শন (স্বরভক্তি ঘটেছে)
• ভেল = হলো (ব্রজবুলি শব্দ)
• আঁচর = অঞ্চল, আঁচল, শাড়ির প্রান্ত
• মহানিধি = মহামূল্যবান সম্পদ বা ধন
• তব = তবুও
• হাম = আমি
• ওঢ়নী = ওড়না, গায়ের আবরণ
• গীরিষের = গ্রীষ্মের (গ্রীষ্ম > গীরিষ)
• বা = বায়ু, বাতাস
• বরিষার = বর্ষাকালের (বর্ষা > বরিষা)
• ছত্র = ছাতা
• দরিয়া = নদী বা সমুদ্র
• ভণয়ে = বলছে, বলে
• শুন = শোনো
• বরনারি = সুন্দরী (এখানে রাধিকার সম্বোধনসূচক শব্দ)
• সজনক = সৌভাগ্যবতীকে

∆ কবিতার উৎস—

• কলিকাতা বিশ্ববিদ্যালয় প্রকাশিত “বৈষ্ণব পদাবলী” সংকলন।

• এছাড়াও আরো কয়েকটি বৈষ্ণব পদ সংকলন গ্রন্থে এই কবিতাটি সংকলিত হয়েছে।

∆ কবিতার পর্যায়—

• কলিকাতা বিশ্ববিদ্যালয় প্রকাশিত “বৈষ্ণব পদাবলী” সংকলন গ্রন্থে কবিতাটি “ভাবোল্লাস ও মিলন’ পর্যায়ে অন্তর্ভুক্ত হয়েছে।

• তবে শিক্ষাসংসদের পাঠ্য অনুযায়ী এটি “ভাব সম্মিলন” “ভাব সম্মিলন” পর্যায়ের। যদিও উভয়েই একার্থে প্রযুক্ত হয়েছে।

∆ কবিতার মূলভাব—

শ্রীকৃষ্ণ মথুরায় গমন করলে শুরু হয়
রাধিকার বিরহ। এই বিরহ ও বিকারের আবেশে রাধা কল্পনার মাধ্যমে কৃষ্ণের সঙ্গ- সুখ উপভোগ করছেন– একেই ভাব সম্মিলন বা ভাবোল্লাস নাম দেওয়া হয়েছে। বিদ্যাপতির এই পদ বা কবিতাটিতেও বিরহে কাতর রাধাও যেন স্বপ্নে কিংবা কল্পনায় শ্রীকৃষ্ণের দেখা পেয়েছেন; তাই তাঁকে আর ছেড়ে দিতে চান না। অর্থাৎ এই পর্যায়ের কবিতাও প্রকান্তরে বিরহেরই কবিতা।

∆ কবিতার সারাংশ—

শ্রীরাধিকা তাঁর সখীকে জানাচ্ছেন :

• হে সখি, আমার সীমাহীন আনন্দের কথা কী আর বলব; চিরকাল মাধব শ্রীকৃষ্ণ আমার হৃদয়-মন্দিরে থাকবেন।

• পাপী চন্দ্রকিরণ আমাকে যত না কষ্ট দিয়েছে, প্রিয় মাধবের মুখ দর্শনে আমি ততটাই সুখ পেয়েছি।

• যদি কেউ আঁচল ভরে মহামূল্যবান রত্নও দেয়, তবুও আমি প্রিয়তমকে দূর দেশে পাঠাবো না।

• প্রিয় আমার শীতের ওড়না, গ্রীষ্মের বাতাস, বর্ষার ছাতা, উত্তাল নদীর নৌকো মতো।

• বিদ্যাপতি বলেন, শুন ওহে বরনারী রাধিকা, যে হয় সুজন বা সৌভাগ্যবতী তাঁর দুঃখ চিরকালের নয় বরং স্বল্পকালের।

∆ বিস্তারিত আলোচনা—

ভাব সম্মিলন কবিতার কবি পরিচিতি : মধ্যযুগের অন্যতম পদকর্তা তথা কবি বিদ্যাপতি বৈয়ব পদাবলী সাহিত্যাকাশে এক উজ্জ্বল জ্যোতিষ্ক। প্রাক্-চৈতন্যযুগের এই কবি অবাঙালি হয়েও বাংলা সাহিত্যে চিরকালীন আসন লাভ করেছেন। শ্রীচৈতন্যদেব থেকে রবীন্দ্রনাথ- সকলেই তাঁকে আত্মার আত্মীয় রূপে বরণ করে নিয়েছেন।

জন্ম, বংশপরিচয় ও কর্মজীবন : চৈতন্য-পূর্বযুগের এই কবি অর্থাৎ বিদ্যাপতি ১৩৭০ খ্রিস্টাব্দের কাছাকাছি সময়ে মিথিলার মধুবনী পরগনার অন্তর্গত বিসফী গ্রামের এক ব্রাহ্মণ বংশে জন্মগ্রহণ করেন। পিতার নাম গণপতি ঠাকুর। বিদ্যাপতির পূর্বপুরুষদের অনেকেই মিথিলার রাজসভার উচ্চপদস্থ কর্মচারী ছিলেন। বিদ্যাপতিও সেইসময় বেশ কয়েকজন রাজার রাজত্বকালে মিথিলার রাজসভা অলংকৃত করেছিলেন। কিন্তু রাজসভায় বসে তিনি শুধু রাধাকৃষ্ণ লীলা বিষয়ক পদ এবং শিব সংগীতই রচনা করেননি; তিনি একাধারে পদকর্তা, সভাসদ, রাজকর্মচারী, সেনাপতি এবং সংস্কৃত ও মৈথিলি ভাষায় নানা গ্রন্থের গ্রন্থকার ছিলেন। বিদ্যাপতি তাঁর বিভিন্ন গ্রন্থে যেসব নরপতির কথা উল্লেখ করেছেন তাঁদের মধ্যে আছেন-কীর্তিসিংহ, রাজা দেবসিংহ, রাজা শিবসিংহ, রাজা পদ্মসিংহ, রাজা নরসিংহ দেব, রাণী বিশ্বাস দেবী, রাণী ধীবরমতী, রাজা ভৈরবসিংহ প্রমুখ। এর ফলে মিথিলার রাজনৈতিক, সামাজিক, সাংস্কৃতিক জীবনের বিচিত্র তরঙ্গভঙ্গ তাঁর দীর্ঘ পরমায়ুকে নানাভাবে আন্দোলিত করেছে।

সৃষ্টিকর্ম : বিদ্যাপতি তাঁর সুদীর্ঘ জীবনে বহু গ্রন্থ রচনা করেছেন, যেগুলি থেকে তাঁর ভাষাজ্ঞান এবং পান্ডিত্যের অসাধারণ পরিচয় পাওয়া যায়। তৎকালে বিদ্যাপতির বিভিন্ন বিষয়ে এত গ্রন্থরচনা পাঠকের মনে বিস্ময়ের সৃষ্টি করে। তাঁর উল্লেখযোগ্য রচনাগুলি হল- ‘বিভাগসার’ ‘দানবাক্যাবলী’, ‘দুর্গাভক্তিতরঙ্গিনী’, ‘গঙ্গাবাক্যাবলী’, ‘বাড়িভক্তি তরঙ্গিনী’, ‘শৈবসর্বস্বহার’, ‘কীর্তিলতা’, ‘কীর্তিপতাকা’, ‘ভূপরিক্রমা’, ‘পুরুষপরীক্ষা’, ‘লিখনাবলী’, ‘গোরক্ষবিজয়’, ‘মণিমঞ্জরী’ প্রভৃতি।

কাব্যপ্রতিভা: মহাপ্রভু চৈতন্যদেব বিদ্যাপতির পদ আস্বাদন করতেন- বিদ্যাপতির কবিপ্রতিভার এটি একটি অখণ্ডনীয় প্রমাণ: সংস্কৃত ভাষায় হলেও বাঙালি কবি জয়দেবই সর্বপ্রথম বৈয়ব পদ রচনা করেছিলেন, কিন্তু তাঁর পদ কান্ত-কোমল হওয়া সত্ত্বেও মনে হয় উত্তরকালে বিদ্যাপতিই অধিকতর অনুকরণযোগ্য বলে বিবেচিত হয়েছিলেন। জয়দেব ও বিদ্যাপতি উভয়েই দেহবিলাস ও সম্ভোগ বর্ণনার কবি। সম্ভবত উভয়েই রাজসভার কবি ছিলেন বলেই তাঁদের রচনায় আধ্যাত্মিকতা আরোপ করতে হয়, তা আসলে দেহাশক্তিই বটে। তবে এটাও সত্য যে সৌন্দর্য প্রীতির জন্যই তাঁর দেহ বর্ণনার ওপর এত গুরুত্বদান করেছিলেন। অধিকাংশ ক্ষেত্রেই তাই রূপাসক্তি ভোগসক্তিকে অতিক্রম করে গেছে। বড়ু চণ্ডীদাসের শ্রীকৃষ্ণকীর্তনের চেয়ে বিদ্যাপতি-জয়দেবের রচনা মার্জিত, অগ্রাম্য ও শ্লীলতাপূর্ণ। বস্তুত সম্ভোগ বর্ণনাও তাঁদের রচনায় এক কল্পজগতের বস্তু হয়ে দাঁড়িয়েছে। বিদ্যাপতি ও জয়দেব এই পর্যন্তই সদৃশ, এর পরেই মনে হয় বিদ্যাপতি জয়দেবকে অতিক্রম করে গেছেন। জয়দেব রাধাকৃষ্ণের লীলার অংশমাত্র, তাঁদের যৌবনবিলাসের কয়েকটি দিনের চিত্রমাত্র অঙ্কন করেছেন; আর বিদ্যাপতির রচনায় রাধাকৃষ্ণের লীলাবৈচিত্র্য পরিপূর্ণভাবে রূপলাভ করেছে। প্রেমের উন্মেষ থেকে প্রেমের চরম পরিণতি পর্যন্ত স্তরে স্তরে বিভিন্ন অবস্থা বর্ণনাতেও বিদ্যাপতি অনুপম কৃতিত্ব প্রদর্শন করেছেন। তিনি প্রেমকে কেবল একটি জৈবিক বৃত্তিমান বলে মনে করেননি, তাই তাঁর অঙ্কিত প্রেমের সঙ্গে জড়িয়ে আছে লজ্জা, ভয়, ঈর্ষা, ছলনা, উদ্বেগ, হর্ষাদি প্রভৃতি বিভিন্ন মানসিক বৃত্তি। রবীন্দ্রনাথ বিদ্যাপতির রাধা প্রসঙ্গে বলেছেন- “বিদ্যাপতির রাধা অল্পে অল্পে মুকুলিত বিকশিত হইয়া উঠিতেছে। সৌন্দর্য ঢল ঢল করিতেছে। শ্যামের সহিত দেখা হয় এবং চারিদিকে যৌবনের কম্পন্ন হিল্লোলিত হইয়া উঠে। খানিকটা হাসি, খানিকটা ছলনা, খানিক আড়চক্ষে দৃষ্টি।… আপনাকে আধখানা প্রকাশ এবং আধখানা গোপন, কেবল উদ্দাম বাতাসের একটা আন্দোলনে অমনি খানিকটা উন্মেষিত হইয়া পড়ে।” বিদ্যাপতি প্রধানত সম্ভোগরসের কবি, তাঁর কাব্যে প্রেমের যে জীবন্ত রূপ ধরা পড়েছে, তা ব্যক্তিসত্তার ঊর্ধ্বে সার্বজনীন অনুভূতিলোকে উন্নীত হওয়ার দাবি রাখে বলেই বিদ্যাপতির প্রেম একান্তভাবেই বৈয়বোচিত না-হওয়া সত্ত্বেও বৈয়বজনের অন্তরের বস্তু। বিদ্যাপতি রাধিকার বিচিত্র অনুভূতির কথা প্রকাশ করলেও বিরহবেদনা এবং মিলনোল্লাস বর্ণনাতেই তিনি আপনাকে অতিক্রম করে গেছেন। গীতিকাব্যের প্রাণরূপে পরিচিত ভাবাবেশ এখানেই সর্বাধিক গভীর। বিদ্যাপতির কাব্যে এই ভাবসমাবেশের জন্যই মহাপ্রভু অকৃপণভাবে তা থেকে রস-উপলব্ধির সুযোগ পেয়েছিলেন।

মৃত্যু : এহেন মধ্যযুগের বৈয়ব পদাবলী সাহিত্যাকাশের উজ্জ্বল জ্যোতিষ্কের (বিদ্যাপতির) প্রয়াণ ঘটে ১৪৫০ খ্রিস্টাব্দের পরে কিন্তু ১৪৭৭ খ্রিস্টাব্দের আগে কোনো এক সময়ে।

∆ ভাব সম্মিলন কবিতার প্রসঙ্গকথা—

বাংলা সাহিত্যে বিদ্যাপতির অন্তর্ভুক্তির কারণ : বিদ্যাপতি বাঙালি ছিলেন না, বাংলা ভাষায় একটি পদও রচনা করেননি; তবুও তিনি বাংলা সাহিত্যে অন্তর্ভুক্ত হয়েছেন। কারণ,

প্রথমত, বিদ্যাপতির সময়কালে মিথিলা ও বাংলা দেশের মধ্যে রাজনৈতিক শিক্ষা-সাংস্কৃতিক ও ভাষাতাত্ত্বিক আদানপ্রদান ছিল। বাংলার ছেলেরা মিথিলায় অধ্যয়ন করে দেশে ফেরার সময় বিদ্যাপতির পদ সাথে করে নিয়ে আসত। ভাষাগত সাদৃশ্যের জন্য বাঙালিরা সহজেই মৈথিলি ভাষা বুঝত আর এই কারণেই মিথিলার কবি বিদ্যাপতি বাংলা দেশে পরিচয় ও প্রতিষ্ঠা পান।

দ্বিতীয়ত, স্বয়ং চৈতন্যদেব বিদ্যাপতির রাধাকৃষ্ণ বিষয়ক পদগুলি শুনতে ভালোবাসতেন বলেই তাঁর ভক্তগোষ্ঠীর মধ্যেও বিদ্যাপতির পদাবলীর প্রভূত প্রভাব পড়েছিল।

তৃতীয়ত, বাংলা ভাষায় রচিত পদসমূহে বিদ্যাপতির যথেষ্ট প্রভাব পড়েছিল। বাংলার বৈষ্ণব কবিরা বিশেষ করে গোবিন্দদাস বিদ্যাপতির অনুসরণে ব্রজবুলি ভাষায় পদ রচনা করেই স্মরণীয় হন। তিনি দ্বিতীয় বিদ্যাপতি নামেও খ্যাত। চতুর্থত, বাঙালির ঐকান্তিক আগ্রহেই বিদ্যাপতির শ্রেষ্ঠ পদগুলি রক্ষিত হয়েছে। বৈষ্ণব পদকর্তা এবং কীর্তনীয়াদের কৃপায় তাঁর এমন বহুপদ আমরা – পাই যেগুলি মিথিলাতেও পাওয়া যায়নি।

পঞ্চমত, বাংলা বৈষ্ণব ভাবাপন্ন দেশ। আর রাধাকৃষ্ণের কাহিনি এদেশে অনুরাগ ও ভক্তির সঙ্গেই পঠিত হয়। তাই বিদ্যাপতির পদাবলী রসিক বাঙালির কোমল অন্তরে সহজেই স্থান করে নিয়েছে। বলা যায় এখানেই বিদ্যাপতি ও তাঁর পদগুলির নবজন্ম ঘটেছে। বলতে ইচ্ছে করে মিথিলা তাঁর জন্মভূমি হলেও তাঁর চিরন্তন বাসভূমি যেন বাঙালির হৃদয়মন্দিরে।

পরবর্তী বাংলা সাহিত্যে বিদ্যাপতির প্রভাব: প্রাক্-চৈতন্যযুগের কবি বিদ্যাপতি মিথিলার অধিবাসী হলেও বাঙালির জীবন ও সাধনার সঙ্গে সুগভীর আত্মীয়তার বন্ধনে আবদ্ধ। রসিক বাঙালি পাঠকসমাজ তাঁর পদাবলীর রসমাধুর্য উপভোগ করে তাঁকে ‘অভিনব জয়দেব’ এবং ‘মৈথিলি কোকিল’ অভিধায় ভূষিত করেছেন। শ্রীচৈতন্য থেকে রবীন্দ্রনাথ সকলেই তাঁর পদাবলীর রসাস্বাদন করে তৃপ্ত হয়েছিলেন। প্রাচীন বাংলা সাহিত্যে অবাঙালি কবিদের মধ্যে বিদ্যাপতির প্রভাব সর্বাধিক। তাঁর প্রভাবগুলি হল-

(১) জয়দেবের ‘গীতগোবিন্দম’ ও বড়ু চণ্ডীদাসের ‘শ্রীকৃষ্ণকীর্তন’ কাব্যের মধ্য দিয়ে বাঙালি রাধাকৃষ্ণের প্রণয়লীলার স্বাদ আস্বাদন করেছেন। সেই স্বাদ উপভোগ্য হয়ে ওঠে বিদ্যাপতির পদে।

(২) মধ্যযুগের বাঙালির সাহিত্য ও সংস্কৃতিতে বিদ্যাপতির অবদান চিরস্মরণীয়। সংস্কৃত অলংকার শাস্ত্রে পান্ডিত্য থাকার জন্য তিনি রাধাকৃষ্ণের প্রণয়লীলাকে পূর্বরাগ থেকে ভাব সম্মিলন পর্যন্ত কয়েকটি নির্দিষ্ট পর্যায়ে বিভক্ত করে বৈষ্ণব সাহিত্যের পথ তৈরি করে দেন। বিদ্যাপতির সেই পথকে বাদ দিয়ে বাংলা সাহিত্যে বৈষ্ণব পদাবলীর আলোচনা সম্পূর্ণ হতে পারে না।

(৩) রাজসভার কবি বিদ্যাপতির কাব্যে সম্ভোগে, আদিরস এবং বাবৈদগ্ধের প্রাচুর্য থাকলেও চিরন্তন প্রেমের প্রকাশেও উজ্জ্বল ছিল। বিদ্যাপতির পদ থেকেই বাঙালি প্রথম অপার্থিব প্রেমের সৌরভ লাভ করে। তাই শ্রীচৈতন্য থেকে রবীন্দ্রনাথ সকলেই বিদ্যাপতিকে আপনার হিসেবে গ্রহণ করেছেন।

(৪) বিদ্যাপতির পদের সুললিত ভাষা এবং গীতিমূর্ছনা বাংলা সাহিত্যের সম্পদ। সমালোচকরা বৈষ্ণব পদাবলীর মধ্যে যে গীতিধর্মিতার অন্বেষণ করেন তার অন্যতম কারণ বিদ্যাপতির পদসমূহ।

(৫) বিদ্যাপতি ব্রজবুলি ভাষায় পদ রচনা করেছেন। এই ভাষার মাধুর্য বৈষ্ণব কবি গোবিন্দদাসকে আকৃষ্ট করে এবং তিনি তাঁর ভাব ও ভাষাকে এতটাই অনুসরণ করেন যে তিনি ‘দ্বিতীয় বিদ্যাপতি’ নামে খ্যাত হয়েছেন। রবীন্দ্রনাথ স্বয়ং এই ভাষার মাধুর্যে বিমোহিত হয়ে ‘ভানুসিংহের পদাবলী’ রচনা করেন।

পরিশেষে বলা যায়, ‘মাথুর’ পর্যায়ের বিরহের পদগুলি বাংলা সাহিত্যের চিরন্তন সম্পদ। বিরহের এমন শিথিল প্রকাশ শুধু মধ্যযুগে নয় আধুনিক যুগেও দুর্লভ। তা ছাড়া ‘প্রার্থনা’ পর্যায়ে বিদ্যাপতির ভক্তিভাব যেভাবে প্রকাশ পেয়েছে সেই ভক্তিবাদ সমগ্র মধ্যযুগীয় বাংলা সাহিত্যের মূলসুর। ভাষা, ভাব, ছন্দ প্রভৃতি সবদিক দিয়েই বিদ্যাপতি বাংলা সাহিত্যের ক্রমবিকাশে বিশেষ প্রভাব বিস্তার করেছিলেন তাই মিথিলার কবি হয়েও তিনি কখন যেন বাংলার ও বাঙালির কবি হয়ে উঠেছেন।

ব্রজবুলি : প্রথমে বিদ্যাপতির পদে এই বিশেষ ধরনের ভাষাটি পাওয়া যায়, পরবর্তীতে গোবিন্দদাসের পদে; সেইজন্য গোবিন্দদাসকে দ্বিতীয় বিদ্যাপতি বলা একটি অনতম কারণ।

বৈষ্ণব পদাবলীতে ব্রজবুলি ভাষার ব্যাবহারিক ঐতিহ্য অনেক আগেই সুবিদিত। অথচ এই ভাষার জন্ম সম্পর্কে আমাদের ধারণা অর্ধস্বচ্ছ। বস্তুত ‘ব্রজবুলি’ কথাটি খুব প্রাচীন নয়, অপেক্ষাকৃত আধুনিক কালেই এর উদ্ভব হয়। উনবিংশ শতাব্দীতে ঈশ্বর গুপ্ত এই নামটি ব্যবহার করেন। মূল শব্দটি সম্ভবত ‘ব্রজাওলি’ অর্থাৎ ব্রজ সম্পর্কিত। একসময় মনে করা হত ব্রজধাম অর্থাৎ বৃন্দাবনের ভাষাই হল ব্রজবুলি। কিন্তু বৃন্দাবনে প্রচলিত ভাষা আর বৈয়ব পদাবলীতে ব্যবহৃত ব্রজবুলি এক নয়। অনেকে মনে করেন বিদ্যাপতির মৈথিলি ভাষায় রচিত পদগুলি বিকৃত প্রাপ্ত হয়ে ব্রজবুলির উৎপত্তি হয়েছে।

কারও কারও মতে, বিদ্যাপতিই এই ব্রজবুলি ভাষার সৃষ্টি করেছেন। এসব প্রচলিত ধারণা ঠিক নয়, আসলে এই ভাষার জন্মরহস্য নিহিত আছে ‘অবহট্ট’ ভাষার মধ্যে। অবহট্টের একটা কৃত্রিম সাহিত্যিক রূপ অবলম্বনে গড়ে উঠেছে ব্রজবুলি। ভাষাতাত্ত্বিকেরাই এই ভাষার একটা সুষ্ঠু ব্যাকরণসম্মত রূপও প্রত্যক্ষ করেছেন। ‘ব্রজবুলি’ ভাষা সম্পর্কে ড. সুকুমার সেন বলেছেন, “ব্রজবুলির বীজ হইতেছে ‘লৌকিক’ অর্থাৎ অবহট্ট। …ব্রজবুলির বীজ অঙ্কুরোদ্ভিন্ন হইয়াছিল সম্ভবত মিথিলায়। বাঙ্গালায় তাহা প্রতিরোপিত হইয়া বৃদ্ধি পাইয়াছিল।” ব্রজবুলি বিদ্যাপতির মৈথিলি পদের বিকৃত রূপ না-হলেও বিদ্যাপতির হাতেই এ ভাষার যথার্থ শিল্পরূপটি গড়ে উঠেছিল।

বাংলা দেশে প্রথম ব্রজবুলি ভাষায় পদ রচনা করেন যশোরাজ খান। মিথিলায় প্রথম ব্রজবুলি পদ রচনার কৃতিত্ব ‘উমাপতি ওঝার’। ওড়িশা ও অসমেও এই পদ রচিত হয়। সমগ্র উত্তর ভারতে ব্রজবুলি পদের প্রচলন ঘটলেও পদাবলী রচনায় এই ভাষার যথার্থ অনুশীলন হয়েছে বাংলার মাটিতে। ব্রজবুলি ভাষা কোমল ও শ্রুতিসুখকর। এই ভাষার সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য কবি গোবিন্দদাস। স্বয়ং রবীন্দ্রনাথও অল্পবয়সে এই ভাষায় রচনা করেছেন ‘ভানুসিংহের পদাবলী’।

ভাব সম্মিলন কী ?

‘ভাব সম্মিলন’ কথার সাধারণ অর্থ হল ভাবের জগতে মিলন। বিদ্যাপতির কাব্যবিশ্লেষণ ও কৃতিত্ব আলোচনা করতে গেলে কয়েকটি বিশেষ রসপর্যায় সম্পর্কে অবহিত হওয়া একান্ত প্রয়োজন। তাঁর রচিত পদগুলিতে শ্রীরাধিকার পর্যায়ক্রমিক বিকাশ অঙ্কিত হয়েছে। বয়ঃসন্ধি, পূর্বরাগ, অভিসার, মাথুর, বিরহ, ভাবোল্লাস বা ভাব সম্মিলন ও প্রার্থনা ইত্যাদি পদের মাধ্যমে শ্রীরাধিকার ক্রমবিকাশ ঘটেছে। এইরকমই একটি পর্যায় হলো ভাবোল্লাস বা ভাব সম্মিলন। শ্রীকৃষ্ণ অঙ্কুরের রথে চড়ে শেষবারের মতো বৃন্দাবন বা ব্রজধাম ছেড়ে মথুরায় চলে যান এবং আর কোনোদিনই বৃন্দাবনে ফিরে আসেননি। তাঁর বৃন্দাবনলীলা এভাবেই সমাপ্ত হয়। বিরহের পর যেসকল মিলনের পদ বৈষ্ণব পদাবলী কাব্যে দেখতে পাওয়া যায়, তা পুনর্মিলনের বর্ণনা নয়। মাধবের (শ্রীকৃষ্ণ) সাথে রাধার আর সাক্ষাৎ হয়নি। বিরহের আতিশয্যে রাধা কল্পনা করতেন, মাধব আবার এসেছেন, তাঁদের উভয়ের মিলন হয়েছে; এটাই ভাব সম্মিলন। এককথায় বলা যায়-ভাবজগতে রাধাকৃষ্ণের মিলনকে ভাবোল্লাস বা ভাব সম্মিলন বলে। ভাবোল্লাসে রাধাকৃষ্ণের মিলনলীলা সম্পূর্ণ হয় বৃন্দাবনের রূপজগতে নয়, রাধার আন্তর্জগতের বৃন্দাবনে। বিদ্যাপতির এইসকল পদ অতি উচ্চশ্রেণির, তাঁর সমকক্ষ আর কোনো কবি নেই। কখনও রাধা স্বপ্ন দেখছেন যে মাধব এসেছেন, কখনও মাধব ফিরলে রাধা কী করবেন তার উল্লেখ করছেন। কখনও মোহাবেশে তাঁকে সম্বোধন করছেন। প্রকৃত চাক্ষুষ সাক্ষাৎ আর তাঁদের ঘটেনি।

দ্বিতীয় সেমিস্টার বাংলা প্রশ্নোত্তর

ছুটি পাঠ্য বইয়ের গল্প

ছুটি গল্পের বিষয়বস্তু

ছুটি গল্পের প্রশ্ন উত্তর

তেলেনাপোতা আবিষ্কার পাঠ্য বইয়ের গল্প

তেলেনাপোতা আবিষ্কার গল্পের বিষয়বস্তু

তেলেনাপোতা আবিষ্কার গল্পের প্রশ্নোত্তর

ভাব সম্মিলন কবিতার বিষয়বস্তু

ভাব সম্মিলন কবিতার প্রশ্ন উত্তর

লালন শাহ্ ফকিরের গান বিষয়বস্তু

লালন শাহ্ ফকিরের গান প্রশ্নোত্তর

নুন কবিতার বিষয়বস্তু

নুন কবিতার প্রশ্ন উত্তর

আগুন পাঠ্য বইয়ের নাটক

আগুন নাটকের বিষয়বস্তু

আগুন নাটকের প্রশ্ন উত্তর

বই কেনা প্রবন্ধের প্রশ্ন উত্তর

আজব শহর কলকেতা প্রবন্ধের প্রশ্নোত্তর

পঁচিশে বৈশাখ প্রবন্ধের প্রশ্ন উত্তর

আড্ডা প্রবন্ধের প্রশ্ন ও উত্তর

আধুনিক বাংলা সাহিত্যের ধারা (৩য়) প্রশ্নোত্তর

লৌকিক সাহিত্যের নানা দিক (৪র্থ) প্রশ্নোত্তর

📌 আরো দেখুনঃ

📌 একাদশ শ্রেণি প্রশ্নপত্র সেমি-২ Click Here

📌 একাদশ শ্রেণি প্রশ্নোত্তর বাংলা Click Here

📌 একাদশ শ্রেণি সিলেবাস বাংলা Click Here

WhatsApp Group Join Now
Telegram Group Join Now

Leave a Reply

  • Post comments:0 Comments
  • Reading time:11 mins read