আজব শহর কলকেতা প্রবন্ধের প্রশ্নোত্তর দ্বিতীয় সেমিস্টার একাদশ শ্রেণি বাংলা | Ajob Sohor Kolketa Probondher Question Answer 2nd Semester Class 11 Bengali wbchse
📌 একাদশ শ্রেণি প্রশ্নপত্র সেমি-২ Click Here
📌 একাদশ শ্রেণি প্রশ্নোত্তর বাংলা Click Here
📌 একাদশ শ্রেণি সিলেবাস বাংলা Click Here
রচনাধর্মী প্রশ্নোত্তর : আজব শহর কলকেতা প্রবন্ধ দ্বিতীয় সেমিস্টার একাদশ শ্রেণি বাংলা | Ajob Sohor Kolketa Probondho Essay Type Question Answer 2nd Semester Class 11 Bengali wbchse
∆ অনধিক একশো পঞ্চাশ শব্দে উত্তর দাও : প্রতিটি প্রশ্নের মান-৫
১. “অমনি মনের মধ্যে গুনগুনিয়ে উঠল মা’র কাছে শেখা গান।”- মা’র কাছে শেখা গানটি কী ? কোন্ প্রসঙ্গে এই উক্তি করেছেন লেখক ? ১+৪ (২০১৯)
উত্তরঃ সুভাষ মুখোপাধ্যায়ের ‘আমার বাংলা’ গ্রন্থের ‘কলের কলকাতা’ শীর্ষক পরিচ্ছেদে স্বাধীনতা সংগ্রামের প্রেক্ষাপটে কলকাতা নগরীর কাহিনি বিবৃত হয়েছে। লেখক তাঁর মায়ের কাছে যে গানটি শিখেছিলেন সেটি হল- ‘ও তোর শিকল পরা ছল। শিকল পরে শিকলরে তুই করবি রে বিকল’।
স্বাধীনতা সংগ্রামের বিক্ষুব্ধ জোয়ারে তখন সারা কলকাতা উত্তাল হয়ে উঠেছিল। এমন সময় লেখকদের বাড়িওয়ালা রামদুলালবাবু একবার জেলে গিয়েছিলেন। কদিন পরেই রামদুলালবাবুর দাদা লেখককে রামদুলালবাবুর সঙ্গে দেখা করতে নিয়ে যাবার প্রস্তাব দেন। আনন্দে আটখানা হয়ে লেখক রাজি হয়ে যান। সেই প্রথম লেখকের জেলখানা প্রত্যক্ষ করার অভিজ্ঞতা হয়।
ইংরেজদের জেলখানায় মাথা উঁচু করে ঢোকার উপায় ছিল না, সকলকে মাথা হেঁট করে ভিতরে যেতে হত। লেখকও তাই করেছিলেন। জেলখানার ভিতরে অনেক স্বাধীনতা সংগ্রামীর সঙ্গে তাঁর সাক্ষাৎ হয়েছিল। সেখানেই লেখক সুভাষচন্দ্র বসুকে দেখেছিলেন।
জেলখানা থেকে বেরিয়ে লেখক স্বাধীনতা সংগ্রামীদের কথা ভাবতে শুরু করেন। তাদেরকে শায়েস্তা করার জন্য ইংরেজ সরকার তাদেরকে জেলখানার অন্ধকার গুহায় ভরে দিত। লেখক ভাবছিলেন, কী পায় তারা? অনেক ভেবেও তিনি যখন উত্তর পেলেন না তখন লেখকের ‘মনের মধ্যে গুনগুনিয়ে উঠেছিল মা’র কাছে শেখা গান।’
২. ‘আজব শহর কলকেতা’ প্রবন্ধে ফরাসি বইয়ের দোকান দেখে লেখকের কী কী মনে হয়েছিল ? দোকানের ভিতরে প্রবেশ করে লেখক কোন অভিজ্ঞতা সঞ্চয় করেছিলেন ? ২+৩=৫
উত্তরঃ সৈয়দ মুজতবা আলী রচিত ‘আজব শহর কলকেতা’ প্রবন্ধে লেখক একদিন প্রবল বৃষ্টিতে ছাতা বা বর্ষাতি না থাকায় আশ্রয়ের সন্ধানে হঠাৎ “French Book Shop” নামের একটি বইয়ের দোকান দেখতে পান। ফরাসি ভাষায় লেখা সেই নাম দেখে প্রথমে তাঁর মনে হয়, কোনো ফরাসি লোক হয়তো কলকাতায় পথ হারিয়ে এসে সামান্য পুঁজিতে বইয়ের দোকান খুলেছে। আবার তাঁর মনে হয় দোকানটি হয়তো শুধু নামেই ফরাসি, ভিতরে হয়তো খুশবাই, সাঁঝের পীর বা লোন্ধ্ররেনুর মতো দেশি বই পাওয়া যাবে। এমন কৌতূহল ও আশ্রয়ের প্রয়োজনে তিনি সেই দোকানে প্রবেশ করেন।
দোকানের ভিতরে ঢুকেই লেখক অবাক হয়ে দেখেন— চারিদিকে শুধু ফরাসি ভাষার বইয়ে ভর্তি তাক। তিনি মনে করেন, ফরাসি বই বিক্রি করেই দোকানদার রোজগার করতে চান। দোকানী ছিলেন এক ফরাসি মেমসাহেব, যিনি ইংরেজি ভালো বুঝতে না পারায় লেখক বাধ্য হয়ে নিজের দুর্বল ফরাসি ভাষায় কথা বলেন। এতে দোকানী খুশি হয়ে তাঁর সঙ্গে আনন্দের সঙ্গে কথা বলেন এবং জানান যে দোকানটি তাঁর বান্ধবীর, তিনি কেবল ফরাসি সাহিত্য প্রচারের জন্য বসেছেন। এর মধ্যে এক বাঙালি যুবক ফরাসি ভাষায় কমার্শিয়াল আর্টের বই খুঁজে লেখককে আনন্দিত করে। লেখক পরে “হিটলার চরিত্র” সম্পর্কিত এক ফরাসি বইও পান। সব মিলিয়ে এই অভিজ্ঞতা লেখকের কাছে ছিল এক আশ্চর্য ও শিক্ষণীয় ঘটনা।
৩. “হঠাৎ একদিন ক্ষেপে উঠল কলের কলকাতা।”- ‘কলকাতার ক্ষেপে ওঠা’ বলতে কী বোঝানো হয়েছে ? কলকাতার ক্ষেপে ওঠার ফল কী হয়েছিল ? ২+৩ (২০১৭)
উত্তরঃ সুভাষ মুখোপাধ্যায়ের ‘আমার বাংলা’ গ্রন্থের ‘কলের কলকাতা’ শীর্ষক পরিচ্ছেদে লেখক ‘ক্ষেপে ওঠা’ কলকাতার পরিচয় দিয়েছেন।
ব্রিটিশ ভারতে কলকাতা ছিল স্বাধীনতা সংগ্রামীদের প্রাণকেন্দ্র। পরাধীনতার বন্ধন মোচন করার জন্য সাধারণ মানুষও সক্রিয় হয়ে উঠেছিল। মিটিং, মিছিল, বিদেশি দ্রব্য বিসর্জন ইত্যাদির মাধ্যমে সাধারণ মানুষ ব্রিটিশ সরকারের বিরুদ্ধে তাদের প্রতিবাদ জানিয়েছিল। সেই সময় পাড়ায় পাড়ায় মিটিং এবং মিটিংয়ে যোগ দেওয়ার জন্য “জনসমুদ্রে জোয়ার” লেগেছিল। কলকাতার ‘ক্ষেপে ওঠা’ বলতে লেখক এই গণ-অভ্যুত্থানকেই ইঙ্গিত করেছেন।
কলকাতার ক্ষেপে ওঠার ফলে কলকাতাবাসীর জীবনযাত্রায় অনেক প্রভাব পড়েছিল। একইসঙ্গে, ক্ষেপে ওঠা কলকাতা লেখকের জীবনেও অনেক প্রভাব ফেলেছিল। সেগুলি হল যথাক্রমে-
প্রথমত, স্বাধীনতা সংগ্রামের জোয়ারে উত্তাল কলকাতার জনজীবনে সাধারণ মানুষের মধ্যে বিভেদ লোপ পেয়ে গিয়েছিল। সকলের তখন একটাই লক্ষ-ভারতের স্বাধীনতা। এইজন্য লেখককেও তখন আর ‘বাঙাল’ বলে কেউ খ্যাপানো হত না।
দ্বিতীয়ত, সকলের মধ্যে বিদেশি দ্রব্য বর্জন এবং স্বদেশি দ্রব্য গ্রহণের প্রবণতা দেখা গিয়েছিল।
তৃতীয়ত, কিশোর লেখক পুলিশের তাড়া খেতে খেতে একদিন কলকাতার রাস্তাঘাট চিনে ফেলেছিলেন।
৪. “এরা মানুষ না আর কিছু”- কার সম্পর্কে একথা বলা হয়েছে ? এমন কথা বলার কারণ কী ?
অথবা, “লোকটা একজন পয়লা নম্বরের ভন্ড”- কার সম্পর্কে একথা বলা হয়েছে ? এমন কথা বলার কারণ কী ?
উত্তরঃ সুভাষ মুখোপাধ্যাযয়ের ‘আমার বাংলা’ গ্রন্থের ‘কলের কলকাতা’ শীর্ষক পরিচ্ছেদে জনৈক সরকারি উকিল সম্পর্কে একথা বলা হয়েছে।
লেখকদের বাড়ি আসতেন একজন সরকারী উকিল। তিনি বাইরের ঘরে বসে লেখকের বাবার সঙ্গে কথাবার্তা বলতেন। বাড়ির অন্য কারো সেই ঘরে যাবার অনুমতি ছিল না। লেখক এবং তার দাদা পর্দার আড়াল থেকে সেই উকিলের কথা শুনতেন। তিনি চট্টগ্রাম অস্ত্রাগার লুন্ঠনের মামলার গল্প বলতেন, গণেশ ঘোষের লেখা কবিতা আবৃত্তি করতেন এবং কল্পনা দত্তের ডায়েরি থেকে পাতার পর পাতা মুখস্থ বলতেন। তার কথা শুনে যেকেউ মনে করবে তিনি হয়তো মাস্টারদা সূর্য সেনের দলেরই লোক। বাংলার বিপ্লবীদের বীরত্বের কাহিনী উক্ত উকিলের বলার গুণে লেখকের কাছে প্রাণবন্ত হয়ে উঠত।
সরকারি উকিল চলে যাওয়ার পর রাগে লেখকের হাত নিসপিস করত। লেখকের মতে “লোকটা একজন পয়লা নম্বরের ভন্ড”। যতই তিনি বিপ্লবীদের জন্য দরদ দেখান না কেন, তিনি তো একজন সরকারি উকিল এবং ব্রিটিশ সরকারের হয়ে বিপ্লবীদের ফাঁসিকাঠে ঝোলানোর বন্দোবস্ত তিনিই করে থাকেন। লোকটার প্রতি ক্ষোভে, ঘৃণায় লেখকের মনে প্রশ্ন জাগে-“এরা মানুষ না আর কিছু ?”
৫. “একা আমি রাস্তায় রাস্তায় ঘুরে বেড়াই”- লেখক কোন রাস্তায় ঘুরে বেড়াতেন ? রাস্তায় ঘোরার সময় তার কোন কোন অভিজ্ঞতা হয়েছিল ?
উত্তরঃ সুভাষ মুখোপাধ্যায়ের ‘আমার বাংলা’ গ্রন্থের ‘কলের কলকাতা’ পরিচ্ছেদে লেখকের কলকাতার রাস্তায় ঘুরে বেড়ানোর অভিজ্ঞতা বর্নিত হয়েছে। তিনি প্রতিদিন বিকেলে বৌবাজারের মোড় থেকে এসপ্ল্যানেড অবধি রাস্তায় রাস্তায় ঘুরতেন।
কলকাতা তখন এত জনাকীর্ন ছিল না। রাস্তায় দুপাশে ছিল শুধু ফাঁকা জমি। মঙ্গলা লেনের কাছে চিনাদের থিয়েটার আর আশেপাশে কিছু পাউরুটি কারখানা ছাড়া বিশেষ কিছু ছিল না। রাস্তায় রিক্সার উপর বসে ছিল এক সন্যাসিনী বুড়ি। তার সর্বাঙ্গ রূপোর গয়না দিয়ে মোড়া। সে ওড়িয়া ভাষায় অনবরত কীসব বলে যাচ্ছিল আর লোকে ভক্তিভরে তার পায়ে পয়সা দিচ্ছিল।
খালি মাঠে খেলা দেখায় এক জাদুকর। কিন্তু পয়সা দেবার ভয়ে সবাই খেলা শেষ হবার আগেই সরে পড়ে। তখন সেই জাদুকর গালশাপ দিতে শুরু করে।
পাশেই একজন হেকিম হরেকরকম গাছগাছড়া, ছাল চামড়া নিয়ে চিকিৎসার পসার নিয়ে বসেছে। তার দাওয়াইয়ের গন্ধে লেখকের অন্নপ্রাশনের ভাত বেরিয়ে আসে।
শীতকালে খালি মাঠে সার্কাসের তাঁবু পড়ে। সার্কাসের ছেলেরা রাস্তার দিকে তাকিয়ে থাকে আর বাঘগুলো মানুষের গন্ধে আমোদিত হয়। হঠাৎ একজন পকেটমার এক ভদ্রলোকের সব ছিনিয়ে নিয়ে যায়। অনেকেই তার পিছু ধাওয়া করে কিন্তু চোর ধরা পড়ে না।
লেখক কখনো কখনো চলে যেতেন সেন্ট্রাল অ্যাভিনিউ-এর রাস্তায়। সেখানকার পরিবেশ যেমন শান্ত তেমনি দরাজ এখানকার আকাশ। লেখক মন্ত্রমুগ্ধের মতো বিকেলবেলাকার কলকাতার রাস্তায় রাস্তায় ঘুরে বেড়াতেন। আর একদিন ভালোবেসে ফেললেন নীরস শহর কলকাতাকে।
৬. মোনা ঠাকুরের ‘কলের কলকাতা’ দেখার অভিজ্ঞতা নিজের ভাষায় লেখ।
উত্তরঃ সুভাষ মুখোপাধ্যায়ের ‘আমার বাংলা’ গ্রন্থের ‘কলের কলকাতা’ শীর্ষক পরিচ্ছেদে মোনা ঠাকুরের কলকাতা দেখার অভিজ্ঞতা বর্নিত হয়েছে। লেখকদের গ্রামেরই ছেলে মোনা ঠাকুর কালীঘাট গিয়েছিল পৈতে নেবার জন্য। সেখান থেকে ফিরে এসে সে তার সমবয়সীদের সঙ্গে নিজের অভিজ্ঞতার কথা বলেছিল। মোনা ঠাকুরের অভিজ্ঞতায় কলকাতা শহরের চরিত্র এইরূপ-
আজব শহর : মোনা ঠাকুরের মতে কলকাতা এক আজব শহর। রাস্তায় লোকে লোকারণ্য। চারিদিকে শুধু গাড়ি আর বাড়ি। হুসহুস করে চলে যায় হাওয়াগাড়ি, রাস্তায় ঠনঠন শব্দে এগিয়ে চলে ট্রাম। কোথাও গ্রামের মতো মাটি নেই-চারিদিকে শুধু চুন, বালি, ইট আর পাথর। কত যে গলি আর কত যে মোড় তার হিসেব নেই এমন আজব শহর কলকাতা।
কলের শহর : কলকাতায় কল টিপলে জল পড়ে আর কল টিপলে অন্ধকার দূর হয়ে আলো জ্বলে উঠে। সেখানে রাত যেন দিনের মতো।
আতঙ্কের শহর : কলকাতার রাস্তায় ঘুরে বেড়ায় একধরণের লোক যাদের মাথায় ঝাঁকড়া ঝাঁকড়া চুল, মুখে ইয়া ইয়া দাড়ি, হাতে লাঠি আর কাঁধে ঝোলানো থাকত ঝুলি। এরা হল ছেলেধরা। মোনা ঠাকুর একবার এক ছেলেধরার পাল্লায় পড়েছিল।
খ্যাপা শহর : মাঝে মাঝে এই শহরের মাথায় খুন চড়ে যায়। শুরু হয় দাঙ্গা। রাস্তায় রক্তগঙ্গা বয়ে যায়। প্রাণের ভয়ে মানুষ পালিয়ে যায়। মোনা ঠাকুরও কলকাতা ছেড়েছিল এই দাঙ্গার ভয়ে।
৭. অসুখ থেকে সেরে ওঠার পর কলের কলকাতা প্রবন্ধে লেখক কলকাতার কী পরিবর্তন দেখেছিল ?
উত্তরঃ বিভিন্ন স্বদেশী ও স্বাধীনতা আন্দোলনের সময় যখন সমস্ত কলকাতা উত্তাল হয়ে উঠেছিল তখন লেখক সুভাষ মুখপাধ্যায় কলকাতাতেই ছিলেন। কিন্তু অসুস্থ থাকার জন্য সুভাষ মুখোপাধ্যায় ফিরিঙ্গি পাড়ার এক ভাড়া বাড়িতে এসে উঠেছিলেন। নিজে সুস্থ হওয়ার পর যখন রাস্তায় নেমে আসলেন তখন তার চোখে নতুন এক কলকাতার চেহারা ধরা দিয়েছিল।
তিনি যখন অসুস্থ হয়েছিলেন তখন সমস্ত কলকাতা তে স্বাধীনতা আন্দোলনের জোয়ার চলছিল চারিদিকে বন্দেমাতরম ধ্বনিতে উত্তাল হয়ে উঠেছিল কলকাতার আকাশ বাতাস। কিন্তু অসুস্থতা থেকে ফিরে এসে তিনি দেখলেন কলকাতা একদম নিস্তব্ধ সেখানে বাস আর ট্রাম্প এখন পাল্লা দিয়ে চলে। কোথাও আর বন্দেমাতরম ধ্বনি শোনা যায় না।
তিনি নতুন কলকাতাতে আরো দেখেছেন চিনা পাড়ার মদের দোকানের সিজ করার ঘটনা। আবার তাকে বাঁচানোর জন্য জুতোর দোকানের মালিক চিং থায় জামিনদার হয়েছে। লেখক কখনো কখনো রাস্তা দিয়ে যাওয়া মোটর গাড়ির নাম্বার গুনতে থাকেন। কখনো বা ইহুদিদের রাস্তার উপর উৎসব পালন করা কে দেখেছেন। রবিবারের দিন হলে গির্জার সামনে খ্রিস্টানদের সংগীত, আর মঙ্গল সমাচার মতিউর পাট শুনেছেন।
এ রকম অবস্থার মধ্যেও তিনি প্রেসিডেন্সি জেলে গেছেন রামদুলাল বাবুর দাদাকে দেখার জন্য। জেলের মধ্যে ঢুকে তিনি সুভাষচন্দ্র কে দেখেছেন। বন্দেমাতরম ধ্বনি তে সমস্ত জেলখানা কেঁপে উঠতে দেখেছেন। আর পরাধীন ভারতবর্ষের সুভাষচন্দ্র বসুর দেশ প্রেমিক সত্ত্বাকে উপলব্ধি করেছেন। তার কিশোর বয়সের সেই দেশপ্রেমিক সত্তাকে বাঙালির মনে প্রাণে তিনি উপলব্ধি করেছেন।
৮. সুভাষ মুখোপাধ্যায়ের ‘কলের কলকাতা’ রচনা অবলম্বন করে গুলিবিদ্ধ ধুতি-পাঞ্জাবি পরিহিত ভদ্রলোক এবং কদম রসুলের পরিচয় দাও।
উত্তরঃ সুভাষ মুখোপাধ্যায়ের ‘কলের কলকাতা’ রচনায় গুলিবিদ্ধ ধুতি-পাঞ্জাবি পরিহিত ভদ্রলোকটি কলকাতার তৎকালীন অস্থির রাজনৈতিক ও সামাজিক পরিস্থিতির এক দুঃখজনক শিকার। তিনি ছিলেন এক সাধারণ নাগরিক, যার জীবনে কোনো বড়ো পরিচয় বা পরিচিতি ছিল না। সমাজের অশান্ত আবহে নিরীহ নাগরিকরাও তখন নিরাপদ ছিলেন না, এবং তিনিও সেই অরাজক অবস্থার বলি হন। তিনি গুলিবিদ্ধ হয়ে রাস্তায় রক্তাক্ত অবস্থায় যন্ত্রণায় ছটফট করছিলেন। তাঁর অসহায় চিৎকার ও মৃত্যুযন্ত্রণা রচনাটিতে কলকাতার অমানবিক নগরজীবনের প্রতীক হিসেবে উঠে এসেছে।
কদম রসুল ছিলেন এই গুলিবিদ্ধ ভদ্রলোকের বন্ধু, আবার এক অর্থে প্রতিপক্ষও। মানবিকতার দৃষ্টিতে তিনি ছিলেন সহৃদয় ও সংবেদনশীল। ভদ্রলোকটি গুলিবিদ্ধ অবস্থায় পড়ে থাকতে দেখে কদম রসুল তাকে একা ফেলে যাননি; তিনি তাকে তুলে ‘কদমতলী’ নামের একটি দোকানে নিয়ে যান এবং যতটা সম্ভব সাহায্য করার চেষ্টা করেন। তার এই আচরণে সহমর্মিতা ও মানবপ্রেমের প্রকাশ ঘটে, যা রচনাটির এক গভীর মানবিক দিক উন্মোচন করে।
শেষ পর্যন্ত গুলিবিদ্ধ ভদ্রলোকটি কদম রসুলের সামনেই মৃত্যুবরণ করেন। তাঁর মৃত্যু কদম রসুলকে গভীরভাবে ব্যথিত করে। বন্ধুর স্মৃতিতে ও শ্রদ্ধাস্বরূপ তিনি ‘কদম’ নামের এক বিশেষ গাছের পাতা এনে মৃতদেহের উপর ছিটিয়ে দেন। এই প্রতীকী কাজের মধ্য দিয়ে কদম রসুল যেন মানবতার প্রতি শেষ শ্রদ্ধা জ্ঞাপন করেন। পুরো ঘটনাটি সুভাষ মুখোপাধ্যায়ের রচনায় এক গভীর সামাজিক ও মানবিক তাৎপর্য প্রকাশ করে।
৯. “ছেলেটার মুখ থুবড়ে মাটিতে পড়ে গেল।” – ছেলেটি মুখ থুবড়ে পড়ে যাওয়ার আগের ঘটনাটি লেখ। ছেলেটি মুখ থুবরে পড়ে যাওয়ার পর কি ঘটেছিলো।
উত্তরঃ প্রখ্যাত সাহিত্যিক সুভাষ মুখোপাধ্যায় তাঁর ‘কলের কলকাতা’ রচনায় স্বাধীনতা আন্দোলনের উত্তাল সময়ের কলকাতার বাস্তব চিত্র ফুটিয়ে তুলেছেন। সেই রচনায় দেখা যায়, এক কিশোর স্বাধীনতার উন্মাদনায় কার্জন পার্কের রাস্তা পার হয়ে সাহেবদের হোটেলের ভিতরে একটি জ্বলন্ত মশাল ছুড়ে ফেলে। মুহূর্তেই হোটেলটি দাউ দাউ করে জ্বলতে ওঠে, এবং সাহেবদের আতঙ্কিত আর্তনাদে চারদিক ভরে যায়। এই দৃশ্য রচনায় স্বাধীনতাকামী যুব সমাজের সাহস ও প্রতিবাদের প্রতীক হিসেবে উঠে এসেছে।
এরপর ছেলেটি হোটেল থেকে ফিরে চৌমাথায় পৌঁছে যায়। সে তখন নিশ্চিন্তে একটি কমলালেবুর খোসা ছাড়াচ্ছিল। হঠাৎই গুলির শব্দে বাতাস কেঁপে ওঠে। সেই শব্দের সঙ্গে সঙ্গে ছেলেটি মুখ থুবড়ে রাস্তায় পড়ে যায়।
এই ঘটনার পর লেখক কলকাতার সেই রক্তাক্ত স্বাধীনতা সংগ্রামের চিত্রটি আরও গভীরভাবে ফুটিয়ে তোলেন। মেডিকেল কলেজের ওয়ার্ডে একের পর এক আহত যোদ্ধা ভর্তি হচ্ছিল। তাদের মধ্যে ছিলেন ধুতি-পাঞ্জাবি পরিহিত এক ভদ্রলোকও, যিনি গুলিবিদ্ধ হয়েছিলেন। তাঁর ক্ষত থেকে রক্ত ঝরছিল, তবুও তাঁর মুখে ছিল গর্বের হাসি। গুলিটি পিঠে লাগলেও তিনি আক্ষেপ করেননি— কারণ এটি ছিল তাঁর আত্মমর্যাদা ও স্বাধীনতার জন্য অর্জিত ক্ষত। তাঁর রক্তাক্ত ধুতি-পাঞ্জাবি যেন সেই সময়ের বিক্ষুব্ধ বাংলার সংগ্রামী চেতনার এক অমর প্রতীক হয়ে উঠেছিল।
১০. ‘সেই ভরসায় ঢুকলুম।’- বক্তা কোন্ ভরসায় কোথায় গেলেন ? সেখানে গিয়ে তিনি কী দেখলেন ?
উত্তরঃ সৈয়দ মুজতবা আলী রচিত ‘আজব শহর কলকেতা’ প্রবন্ধের বক্তা-লেখক কলকাতার বুকে ফরাসি বুক শপ দেখে খুব অবাক হয়ে যান। বিস্ময়ের ঘোর কাটতে তিনি ভাবলেন বাইরে ‘ফ্রেঞ্চ বুক শপ’ লেখা থাকলেও ভিতরে গিয়ে তিনি অবশ্যই পাবেন- ‘খুশবাই’, ‘সাঁঝের পীর’, ‘লোরেণু’, ‘ওষ্ট-রাগ’ ধরনের বইপত্র। কারণ ফরাসি বই বিক্রি করে দোকানদারের মুনাফা হবে না, তাই মুনাফার জন্য ফরাসি বইয়ের দোকানদার হয়তো উক্ত ‘রদ্দি’ শ্রেণির বইপত্রও তাঁর দোকানে রাখবেন। এই ভরসাতেই লেখক ‘ফ্রেঞ্চ বুক শপ’-এ ঢুকেছিলেন।
একদিকে বৃষ্টিও হচ্ছিল প্রবলভাবে, অন্যদিকে ‘রদ্দি’ কিছু পাওয়ার আশায় লেখক তো ফরাসি বইয়ের দোকানে গিয়ে পড়েন কিন্তু সেখানে গিয়ে লেখকের আর বিস্ময়ের সীমা-পরিসীমা রইল না। লেখক বুঝতে পারলেন যে, শুধুমাত্র ফরাসি বই বিক্রি করেই দোকানদার পয়সা উপার্জন করতে চাইছেন, তাই দোকানে নানা প্রকারের ফরাসি বই তিনি রেখেছেন। লেখক দেখতে পান গাদাগাদা হলদে আর সাদা মলাটওয়ালা ফরাসি বই দোকানে রয়েছে। কিছু বইকে সুন্দরভাবে সাজিয়ে-গুছিয়ে রাখা হয়েছে আবার কিছু বই যত্রতত্র ছড়িয়ে-ছিটিয়ে রয়েছে। লেখকের মনে হয় কলকাতায় এসে ফরাসি দোকানদার বাঙালি হয়ে গেছেন। বাঙালি দোকানদারদের মতোই বইগুলিকে সাজিয়েছেন টাইপরাইটারের হরফ সাজানোর মতো করে। অর্থাৎ ‘সিজিল’-টা জানা থাকলে চোখ বন্ধ করেই ইচ্ছামতো বই বের করে নেওয়া যাবে। ফুটফুটে এক মেমসাহেবকে লেখক সেখানে দেখতে পান। ‘ফ্রেঞ্চ বুক শপ’-এ গিয়ে লেখক এমন দৃশ্যই দেখেন।
১১. “সামনে দেখি বড় বড় হরফে লেখা ‘ফ্রেঞ্চ বুক শপ”- এমন লেখা দেখে লেখক কী ভেবেছিলেন, তা পাঠ্য প্রবন্ধ অবলম্বনে লেখো।
উত্তরঃ সৈয়দ মুজতবা আলী রচিত ‘আজব শহর কলকেতা’ নামক প্রবন্ধে দেখা যায় প্রবল বৃষ্টিতে লেখক যখন পথ হারানোর বেদনায় আক্রান্ত, তখনই তাঁর চোখে পড়ে বড়ো বড়ো হরফে লেখা ‘ফ্রেঞ্চ বুক শপ’ লেখাটি। খাস কলকাতার বুকে ফরাসি বইয়ের দোকান দেখে লেখক বেশ বিস্মিত হন। এই অবস্থায় লেখকের মনে দুইপ্রকার ভাবনার উদয় হয়।
প্রথমত, লেখক ভাবেন নিশ্চয়ই কোনো ফরাসি ভুল করে পথ হারিয়ে কলকাতায় এসে পড়েছেন, আর ট্যাকের পয়সা খোয়াবার জন্যই তিনি এখানে ফরাসি বইয়ের দোকান খুলেছেন। কারণ বাঙালি ট্যাকের পয়সা খরচ করে বাংলা বই-ই কিনতে চায় না তো এখানে ফরাসি বই কেই-বা কিনবে। তাই রসিকতার সুরেই লেখক ফরাসি বইয়ের দোকানদারের উদ্দেশ্যে উক্ত কথাটি বলেছেন।
দ্বিতীয়ত, লেখক বাঙালি প্রকাশকদের কাছে শুনেছেন-“শুধু ভালো বই ছাপিয়ে পয়সা কামানো যায় না, রদ্দি উপন্যাসও গাদাগাদা ছাড়তে হয়।” তাই লেখক ভাবলেন শুধু ফরাসি বই ছেপে দোকানে মুনাফা হবে না, ভিতরে অন্য ধরনের বইও হয়তো আছে। অর্থাৎ ‘ফ্রেঞ্চ বুক শপ’ হয়তো হাতির দাঁতের মতোই-শুধু দেখার জন্য; চিবোবার দাঁত রয়েছে ভিতরে লুকানো। অর্থাৎ বাইরে ‘ফ্রেঞ্চ বুক শপ’-এর আড়ালে ভিতরে গিয়ে পাবেন ‘খুশবাই’, ‘সাঁঝের পীর’, ‘ওষ্ট-রাগ’ শ্রেণির কিছু বইপত্র। ‘ফ্রেঞ্চ বুক শপ’ লেখাটি দেখে লেখকের মনে এই ধারণাগুলিই হয়েছিল।
১২. ‘ফুটফুটে এক মেমসাহেব এসে ইতিমধ্যে ফরাসি হাসি হেসে দাঁড়িয়েছেন।’- মেমসাহেব কখন এসে দাঁড়িয়েছিলেন ? মেমসাহেবের পরিচয় দাও।
উত্তরঃ ‘আজব শহর কলকেতা’ নামক প্রবন্ধে দেখা যায় শহর কলকাতার বুকে ‘ফ্রেঞ্চ বুক শপ’ দেখে বিস্মিত লেখক সৈয়দ মুজতবা আলী সেখানে প্রবেশ করেন। তিনি ভেবেছিলেন বাইরে ‘ফ্রেঞ্চ বুক শপ’ লেখা থাকলেও ভিতরে দেখতে পাবেন ‘খুশবাই’, ‘সাঁঝের পীর’ জাতীয় বিষয়। কিন্তু ভিতরে প্রবেশ করে তিনি দেখলেন দোকানদার তাঁর দোকানে কেবল ফরাসি বই-ই রেখেছেন। বই সাজানোর পদ্ধতি দেখে লেখকের অনুমান হয়-ফরাসি দোকানদার কলকাতায় এসে বাঙালি হয়ে গেছেন। এর মধ্যেই মেমসাহেব দোকানে এসে দাঁড়িয়েছিলেন।
লেখক ‘ফ্রেঞ্চ বুক শপ’-এ প্রবেশ করে এক ফুটফুটে ফরাসি মেমসাহেবকে দেখতে পেলেন। গল্প অনুযায়ী মেমসাহেবের যে সংক্ষিপ্ত পরিচয় ফুটে উঠেছে তা হল-মেমসাহেব মুখে ‘ইয়ের ইয়েস’ বললেও তাঁর চোখ দেখে স্পষ্ট বোঝা যায় তিনি ইংরেজি ভাষায় ততটা দক্ষ নন। ফরাসি ভাষাতেও তাঁর পারদর্শিতা কম বলেই কথকের ‘টুটিফুটি’ ফরাসি ভাষা শুনেও তাঁর প্রশংসা করেছিলেন। শুধু তাই নয় অতি সযত্নে কথকের বইয়ের ফর্দ টুকে নিয়ে বই আসামাত্র কথককে খবর দেবেন বলে ভরসাও যুগিয়েছিলেন।
কথকের কাছে তিনি তাঁর পরিচয় দিতে গিয়ে বলেন মাত্র তিন মাস হল তিনি কলকাতায় এসেছেন। তাই ইংরেজি যথেষ্ট জানেন না, তবে কাজ চালিয়ে নিতে পারেন। বইয়ের দোকানটি তাঁর নয়, তাঁর এক বান্ধবীর। বান্ধবীর অনুপস্থিতিতে শুধুমাত্র ফরাসি ভাষা ও সাহিত্যের প্রচার লাভের জন্য তিনি দোকানে বসেছেন।
১৩. ‘তবু সমস্যাটা একই!’- লেখক কখন সমস্যার মধ্যে পড়েছেন ? তখন তাঁর মানসিক অবস্থার পরিচয় দাও।
উত্তরঃ প্রশ্নোদ্ভূত অংশটি সৈয়দ মুজতবা আলী রচিত ‘আজব শহর কলকেতা’ প্রবন্ধ থেকে নেওয়া হয়েছে। উক্তিটির বক্তা লেখক স্বয়ং। লেখক ছেলেবেলা থেকেই শুনে আসছিলেন যে, কলকাতা এক ‘আজব শহর’। শুনেছেন এ কথা কিন্তু তার উপযুক্ত প্রমাণ তিনি কখনোই পাননি। অর্থাৎ শোনা কথা আর বাস্তবে দেখা কলকাতার মধ্যে মিল খুঁজে পাচ্ছিলেন না লেখক। এই বিষয়ে প্রামাণিক একটি প্রবন্ধ লিখবেন বলে তিনি ভাবছিলেন, তখনই নেমেছিল প্রবল বৃষ্টি। এই অবস্থায় তিনি সমস্যায় পড়েছিলেন।
সমস্যাটি হল সমীরণে পথ হারানোর সমস্যা। সরস ভাষায় লেখক বলেছেন-“সমীরণে পথ হারানোর বেদনা বেজে উঠল কারণ যদিও পথ হারাইনি তবু সমস্যাটা একই।” ‘সমীরণ’ কথার অর্থ হল বায়ু বা বাতাস। এখানে লেখক হয়তো ঝড়-বাতাসকেই বোঝাতে চেয়েছেন। কারণ ঝড়-বাতাসে মানুষের পথভ্রষ্ট হওয়ার আশঙ্কা থাকে। ঝড় অনেক ক্ষেত্রেই পরিস্থিতিকে এলোমেলো করে দেয়। তাই এমন অবস্থায় পথ হারাবার ভয় অমূলক নয়। এখানে ঝড়ের কথা না-বললেও প্রবল বৃষ্টির কথা বলেছেন লেখক। তখন লেখকের কাছে কোনো ছাতা বা বর্ষাতিও ছিল না। ট্রামে চড়ার মতো তাগদ তাঁর ছিল না-তাই বাস তো দূরের কথা ট্যাক্সি চড়তেও তাঁর বুক খচখচ করছিল। এইসময় বাড়ি ফেরার চিন্তায় তিনি ব্যাকুল হয়ে পড়েছিলেন। পথ তিনি হারাননি কিন্তু পরিস্থিতি যা হয়েছিল তাতে সমস্যাটা হয়ে দাঁড়িয়েছিল পথ হারানোর মতোই বেদনাদায়ক। তখন লেখক অদ্ভুত মানসিক অস্থিরতায় পড়েছিলেন।
১৪. ‘মেমসাহেব আদেশ দিলেন, ‘মসিয়ো, ফরাসীতে কথা বললেই পারেন’- মেমসাহেব কখন এমন আদেশ দিয়েছিলেন ? তখন উদ্দিষ্ট ব্যক্তির মনোভাব কেমন হয়েছিল লেখো।
উত্তরঃ ‘আজব শহর কলকেতা’ নামক প্রবন্ধে আমরা দেখি প্রবন্ধকার সৈয়দ মুজতবা আলী ‘ফ্রেঞ্চ বুক শপ’-এ প্রবেশ করলে দোকানের ফরাসি মেমসাহেব ফরাসি ভাষায় লেখকের কাছে জানতে চান যে লেখকের ‘কি চাই’। এরপর মেমসাহেবের সঙ্গে লেখকের কথোপকথন চলতে থাকে। মেমসাহেব ফরাসি ভাষায় কথা বললেও, লেখক ইংরেজিতেই কথা বলতে থাকেন। হঠাৎ করেই ফরাসি রাজদূত মসিয়ো ফ্রাঁসোয়া পঁসে-র নাম উচ্চারণ করতে গিয়ে লেখকের মুখ দিয়ে কিছুটা ফরাসি ভাষা বেরিয়ে পড়েছিল। এইসময় সুযোগ পেয়ে মেমসাহেব লেখককে প্রশ্নোদ্ভূত আদেশটি দিয়েছিলেন।
মেমসাহেবের আদেশে লেখকের মনে হল এই আদেশ যেন বাঙালির জাত্যভিমানে আঘাত করার সমতুল্য। কারণ, কেনই-বা তিনি একজন মেমসাহেবের কথায় নিজের ভাষা ছেড়ে মেমের ভাষায় কথা বলতে যাবেন। ফরাসি ভাষার চর্চা একসময় তিনি করেছেন। লেখকের কথামতো বলা যায় এখনও চেষ্টা করলে কেঁদেকুকিয়ে তিনি ফরাসি ভাষায় কথা বলতে পারবেন, তবু তাঁর মন যেন মেমসাহেবের কথার প্রতিবাদ করে ওঠে। আবার তিনি এমনও ভাবেন যে মেমসাহেব যদি কলকাতার বুকের ওপর বসে বাংলা-এমনকি ইংরেজিও না বলতে পারেন, তবে লেখক ফ্রান্স থেকে হাজার মাইল দূরে দাঁড়িয়ে ‘টুটিফুটি’ ফরাসি বললে কোনো দোষই হবে না। অর্থাৎ মেমসাহেবের আদেশ (অনুরোধ) শুনে লেখকের মনে দ্বিধাদ্বন্দুময় অনুভূতির সৃষ্টি হয়েছিল।
১৫. ‘অতি সযত্নে তিনি আমার বইয়ের ফর্দ টুকে নিলেন,’ -‘তিনি’ কোন্ পরিস্থিতিতে বক্তার বইয়ের ফর্দ টুকে নিয়েছিলেন? এর পরে ‘তিনি’ বক্তাকে কী বলেছিলেন?
উত্তরঃ প্রশ্নোদ্ভূত অংশটি সৈয়দ মুজতবা আলী রচিত ‘আজব শহর কলকেতা’ নামক প্রবন্ধ থেকে নেওয়া হয়েছে। এখানে ‘তিনি’ হলেন ‘ফ্রেঞ্চ বুক শপ’-এর ফরাসি মেমসাহেব। ফ্রেঞ্চ বুক শপ-এ প্রবেশ করে মেমসাহেবের সঙ্গে বক্তা অর্থাৎ লেখক সৈয়দ মুজতবা আলী ফরাসি রাজদূত মসিয়ো ফ্রাঁসোয়া পঁসে-র কথা বলতে গিয়ে কিছুটা ফরাসি ভাষা উচ্চারণ করে ফেলেন। তখন সুযোগ পেয়ে মেমসাহেব লেখককে ফরাসিতে কথা বলার অনুরোধ করেন। কিছুটা দ্বিধাদ্বন্দু থাকলেও লেখক ফরাসি ভাষায় কথা বলা শুরু করেন। লেখকের মুখে ফরাসি ভাষা শুনে মেমসাহেব খুব খুশি হন এবং লেখকের প্রশংসা করেন। প্রশংসা শুনে লেখক আরও উৎসাহিত হয়ে ফরাসি ভাষার ব্যাকরণের তোয়াক্কা না-করেই অনর্গল ফরাসি ভাষায় কথা বলতে থাকেন। এইরকম পরিস্থিতিতে খুব খুশি হয়ে, মেমসাহেব অতি যত্নসহকারে লেখকের বইয়ের ফর্দ টুকে নেন।
ফর্দটি লিখে নেওয়ার পর মেমসাহেব লেখককে জানান ফর্দমতো বই আসার সঙ্গে সঙ্গেই তিনি সেই খবর লেখককে জানাবেন বলে ভরসা দেন। সেইসঙ্গে সাত সমুদ্র তেরো নদীর এপারে বিদেশির সঙ্গে মাতৃভাষায় (ফরাসি ভাষায়) কথা বলতে পারার আনন্দে সুখ-দুঃখের দু-চারটি কথাও তিনি লেখককে বলে ফেলেন। তিনি আরও বলেন যে, তিনি এদেশে এসেছেন মাত্র তিন মাস হয়েছে। তাই ইংরেজিতে স্বচ্ছন্দ নন, তবে কাজ চালিয়ে নিতে পারেন। তা ছাড়া বইয়ের দোকান তাঁর নয়, তাঁর এক বান্ধবীর। সেই বান্ধবীর অনুপস্থিতিতে শুধুমাত্র ফরাসি ভাষা ও সাহিত্যের প্রচারের উদ্দেশ্যেই তিনি উক্ত দোকানে বসেছেন।
১৬. ‘আমাকে আর পায় কে ?’- কোন্ প্রসঙ্গে বক্তার এই উক্তি ? উক্তিটির তাৎপর্য ব্যাখ্যা করো।
উত্তরঃ প্রশ্নোদ্ভূত অংশটি সৈয়দ মুজতবা আলীর লেখা ‘আজব শহর কলকেতা’ নামক প্রবন্ধ থেকে নেওয়া হয়েছে। কলকাতার বুকে দেখতে পাওয়া ‘ফ্রেঞ্চ বুক শপ’-এ গিয়ে লেখক দোকানের মেমসাহেবের সঙ্গে কথোপকথনের সময় হঠাৎ করেই কিছুটা ফরাসি ভাষায় কথা বলে ফেলেন। তখন উক্ত মেমসাহেব লেখককে ফরাসিতেই কথা বলতে অনুরোধ করেন। লেখকের মুখে ফরাসি শুনে মেমসাহেব খুব খুশি হয়ে বাহবা দিতে থাকেন। ভালো কিছুর প্রশংসা করতে ফরাসিরা যে পিছিয়ে আসে না, সেই প্রসঙ্গেই লেখক তথা বক্তা প্রশ্নের উক্তিটি করেছেন।
মেমসাহেবের অনুরোধে লেখকের বাঙালি জাত্যভিমানে আঘাত লাগলেও দ্বিধাদ্বন্দু কাটিয়ে লেখক ফরাসি ভাষায় কথা বলতে শুরু করেন। বহুদিনের পুরানো মরচে পড়া অনভ্যাসটাকে নতুন করে শুরু করার মধ্যে যে আনন্দ, তা অনুভব করেন তিনি। মেমসাহেব যতই শোনেন ততই লেখকের প্রশংসা করতে থাকেন এবং বলতে থাকেন- ‘বাহবা বাহবা বাহবা।’ কখনও বলেন- ‘গলা ছাড়িয়া গান গাহো।’ ফরাসিদের এটাই একটা বড়ো গুণ যে, তারা গুণীর এবং গুণের সর্বদা প্রশংসা করতে জানে, এটা তাদের জাতীয় বৈশিষ্ট্য। মেমসাহেবের প্রশংসায় লেখক আরও উৎসাহিত হন এবং তিনি ব্যাকরণ বা প্রকৃত ফরাসি উচ্চারণের তোয়াক্কা না-করেই অনর্গল ফরাসি ভাষায় কথা বলে গেলেন। লেখকের কথা থেকেই বোঝা যায় যে, তিনি কতটা সঠিক ফরাসি উচ্চারণ করেছেন তা নিয়ে নিজেই নিঃসন্দেহ ছিলেন না; তবে মেমসাহেব খুব খুশি হয়েছেন বোঝা যায়। তাই রসিকতার সুরেই তিনি প্রশ্নোদ্ভূত কথাটি বলেছেন।
১৭. ‘আমার মনে বড় আনন্দ হল’-বক্তার আনন্দের কারণ কী ? ‘আজব শহর কলকেতা’-র শেষাংশে লেখক ‘আরেক দিন হবে’ বলেছেন কেন ?
উত্তরঃ ‘আজব শহর কলকেতা’ প্রবন্ধের লেখক সৈয়দ মুজতবা আলী একদিন কলকাতার বুকে অবস্থিত এক ফ্রেঞ্চ বুক শপ-এ প্রবেশ করে দোকানের মেমসাহেবের সঙ্গে আলাপচারিতা শুরু করেন। একসময় লেখক অনুভব করেন যে, একদা পৃথিবীর নানা প্রান্তের মানুষ প্যারিসে জড়ো হত ফরাসি বই বেচবার জন্য। সেইসময় এক ‘বাঙাল ছোকরা’ দোকানে এসে কমার্শিয়াল আর্টের বই-এর খোঁজ করে। এই ঘটনায় লেখকের মনে খুব আনন্দ হয়েছিল। বক্তা আনন্দ পেয়েছেন এই ভেবে যে-বাঙালিরা তাহলে বই কিনছে, এমনকি বিদেশি ভাষার বইয়ের প্রতিও তারা আগ্রহ প্রকাশ করছে। বাঙালিরা গাঁটের পয়সা খরচ করে বই কেনে না বলে অপবাদ রয়েছে, আবার সেই বাঙালিই ফরাসি বই কেনার জন্য সচেষ্ট হয়েছে। অর্থাৎ শিল্প-সংস্কৃতির জগতে বাঙালির অবদান রয়েছে-এটাই বক্তার আনন্দের কারণ।
আলোচ্য রচনার শেষাংশে দেখা গেল লেখক একটি খাসা বই পেয়েছেন। তা হল-ন্যুরনবর্গের মোকদ্দমায় প্রাপ্ত দলিল-দস্তাবেজের সাহায্যে গড়ে তোলা • হিটলারের চরিত্রবর্ণন। হিটলার সম্পর্কে তাঁর শত্রু ফরাসিরা কী ভাবতেন, তার পরিচয় রয়েছে বইটিতে। বইটি সম্পর্কে লিখবেন বলে যেই গৌরচন্দ্রিকা • শেষ করেছেন, তখনই ভোরের কাক ‘কা-কা’ করে লেখককে মনে করিয়ে দেন তার কলম ফুরিয়ে গেছে। অর্থাৎ লেখাটা আর শেষ করা হল না। তাই লেখক বলেছেন-‘আরেক দিন হবে’।
১৮. ‘আজব শহর কলকেতা’ প্রবন্ধের নামকরণের সার্থকতা আলোচনা করো।
উত্তরঃ সাহিত্যের একটি প্রধান অঙ্গ নামকরণ। নামকরণ নানা প্রকারের হতে পারে। যেমন-চরিত্রপ্রধান, বিষয়কেন্দ্রিক, ব্যঞ্জনাধর্মী ইত্যাদি।
লেখক সৈয়দ মুজতবা আলী ছেলেবেলা থেকেই শুনে আসছেন কলকাতা এক আজব শহর, তবে এমন কথা যে সত্যি তার কোনো প্রমাণ তিনি পাননি। এই বিষয়ে একখানা প্রবন্ধ লিখবেন ভাবছেন, এমন সময়েই নামল প্রবল বৃষ্টি। ছাতা নেই, বর্ষাতি নেই, ট্রামে-বাসে চাপার মতো তাগদও (শক্তি) শরীরে নেই। এমন সময়ই তিনি প্রমাণ পেলেন কলকাতা এক আজব শহর। সামনেই দেখলেন বড়ো বড়ো হরফে লেখা ‘ফ্রেঞ্চ বুক শপ’।
কলকাতার বুকে ফ্রেঞ্চ বুক শপ দেখে লেখক অবাক হন। প্রথমে ভাবেন ভুল করেই কোনো ফরাসি এখানে ফরাসি বই-এর দোকান খুলেছেন। আবার তিনি এ কথাও ভাবেন যে, ফরাসি বই বিক্রির আড়ালে অন্যান্য দ্রব্যও হয়তো এখানে বিক্রির ব্যবস্থা থাকবে। দোকানের ভিতরে ঢুকে লেখকের বিস্ময়ের সীমা রইল না। সত্যিই সেখানে ফরাসি বই বিক্রয়ের সুব্যবস্থা রয়েছে। দোকানে গাদাগাদা ফরাসি বই। শহর কলকাতার বুকে এত সুন্দর ফরাসি বইয়ের দোকান দেখে লেখক বিস্মিত হয়েছেন। আবার একইসঙ্গে তাঁর মনে হয়েছে শহর কলকাতাতেই এটা সম্ভব, তাই কলকাতা আজব শহর।
দোকানে রয়েছে ফুটফুটে এক মেমসাহেব। তিনি ইংরেজিতে দক্ষ নন, তাই লেখককে তিনি ফরাসিতে কথা বলার জন্য অনুরোধ করেন। লেখকও সেই অনুরোধ রক্ষা করেন এবং মেমসাহেবের সঙ্গে ফরাসিতে কথোপকথনের মাধ্যমে মেমসাহেবের কুর্নিশ লাভ করেন। আবার যে বাঙালি বই কেনায় কার্পণ্য করে, সেই বাঙালি এক ছোকরা দোকানে ফরাসি ভাষায় কমার্শিয়াল আর্টের বই-এর খোঁজ করে। এক্ষেত্রেও লেখকের মনে হয়েছে, কলকাতা শহরের পক্ষেই এমনটা সম্ভব, তাই আজব এই শহর কলকাতা।
আর একটি বিষয় লক্ষণীয় যে, লেখক প্রবন্ধের নামকরণে ‘কলকেতা’ শব্দটি ব্যবহার করেছেন, ‘কলকাতা’ ব্যবহার করেননি। এক্ষেত্রে সম্ভবত লেখক রসিকতার আশ্রয় নিয়েছেন। অর্থাৎ লেখক ‘আজব’ কথাটি ‘কলকেতা’ শব্দের মধ্যেও প্রয়োগ ঘটিয়েছেন।
পূর্বোক্ত কারণগুলির জন্যই বলা যায় যে, আলোচ্য প্রবন্ধটির ব্যঞ্জনাধর্মী নামকরণ হয়েছে এবং তা সার্থক হয়ে উঠেছে।
◆ দ্বিতীয় সেমিস্টার বাংলা প্রশ্নোত্তর
◆ তেলেনাপোতা আবিষ্কার পাঠ্য বইয়ের গল্প
◆ তেলেনাপোতা আবিষ্কার গল্পের বিষয়বস্তু
◆ তেলেনাপোতা আবিষ্কার গল্পের প্রশ্নোত্তর
◆ ভাব সম্মিলন কবিতার বিষয়বস্তু
◆ ভাব সম্মিলন কবিতার প্রশ্ন উত্তর
◆ লালন শাহ্ ফকিরের গান বিষয়বস্তু
◆ লালন শাহ্ ফকিরের গান প্রশ্নোত্তর
◆ বই কেনা প্রবন্ধের প্রশ্ন উত্তর
◆ আজব শহর কলকেতা প্রবন্ধের প্রশ্নোত্তর
◆ পঁচিশে বৈশাখ প্রবন্ধের প্রশ্ন উত্তর
◆ আড্ডা প্রবন্ধের প্রশ্ন ও উত্তর
◆ আধুনিক বাংলা সাহিত্যের ধারা (৩য়) প্রশ্নোত্তর
◆ লৌকিক সাহিত্যের নানা দিক (৪র্থ) প্রশ্নোত্তর
📌 আরো দেখুনঃ
📌 একাদশ শ্রেণি প্রশ্নপত্র সেমি-২ Click Here
📌 একাদশ শ্রেণি প্রশ্নোত্তর বাংলা Click Here
📌 একাদশ শ্রেণি সিলেবাস বাংলা Click Here
